মানব জীবনে সময়ের মূল্য ও গুরুত্ব

ভূমিকা

অতিবাহিত সময়, চলকে পড়া দুধ, নিক্ষিপ্ত তীর এবং মুখ নিঃসৃত কথা কখনাে ফিরে আসে না।

তাই এগুলির ব্যবহারও যথাযথ হওয়া বাঞ্ছনীয়। আসলে সময়কে গুরুত্ব দিলেই তাে সময়ের সাক্ষী হওয়া যায়। আজকাল কৃত্রিম বস্তুসর্বস্ব যুগে মানুষ এতই অলস যে, সময়ের মূল্য তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছে।

মানব জীবনে সময়ের মূল্য ও গুরুত্ব

সময়ের স্বরূপ

‘সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়’-কবির এই উক্তি সময়ের গুরুত্বকে উপলব্ধি করায়। কেননা সময় এবং নদীর ঢেউ কেউই অপেক্ষা করে থাকে না এটি চিরপ্রচলিত বাণী।

সময় মানুষের জন্য কখনাে থেমে থাকে না, সেজন্য কালের গতির সঙ্গে মানুষকে চলতে হয়।

যেহেতু সময়কে বেঁধে রাখা যায় না, সেজন্য সময়ের মূল্য অসাধারণ। তাই সময়মতাে কাজ করতে হয়।

একটি গল্প আছে- স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করছিলেন রাবণ। কিন্তু ভুল হয়েছিল, সময়কে নিজের মুঠোয় বন্দী করে রাখবার চেষ্টায়। তাই সময় কেটে গেল, কিন্তু রাবণের জীবদ্দশায় স্বর্গের সিঁড়ি তৈরির সেই সুযােগ তিনি হারালেন।

তাই তিনি বলে গিয়েছিলেন, কাজ শুরু করে যাতে ফেলে না রাখা হয়।

সময় চেতনা

স্বল্পস্থায়ী মানুষের জীবনে সময়ের অবহেলা যে কোনাে মানুষের কাছে কাম্য নয়।

এই সময়চেতনা না থাকলে তার কাছে অনেক কাম্য বস্তু হাতছাড়া হতে পারে।

প্রতিটি মুহূর্ত থেকে আখের রসের মতাে রস নিংড়ে, প্রতিটি দিনকে সার্থকতায় ভরিয়ে তুললে, প্রতিটি সেকেণ্ডকে কাজে লাগালে জীবনের উপযুক্ত ব্যবহার হবে।

এই প্রবহমান সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন না হলে, সারাজীবনের মূল্য সম্বন্ধে অজ্ঞ থেকে যেতে হবে, ফলে জীবনের প্রতি অবহেলা আসবে এবং সে কারণে একটি পরিপূর্ণ মানবজন্ম ব্যর্থ হয়ে যাবে।

ঘড়ির এক একটি ক্ষুদ্র স্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে কালের স্রোত তীব্রগতিতে বয়ে চলেছে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পল-অনুপলের সমষ্টি নিয়েই একটি জীবন গড়ে ওঠে।

এই সময় প্রবাহের মধ্যে শিশু জন্ম নেয়, ধীরে ধীরে সে শৈশব থেকে কৈশােরে উত্তীর্ণ হয়, তারপর আসে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব এবং তা থেকে বার্ধক্য। এভাবেই জীবনের বিবর্তন সময়ের সঙ্গে বাঁধা।

সময় হল সম্পদ

পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ হল সময়। তা একবার ফিরে গেলে আর ফিরে না। কিন্তু আমরা সময় প্রবাহের মধ্যে থাকি বলেই সময়কে ততটা মূল্য দিতে শিখি না।

গতকালের পরিবর্তে যখন চিরকালই আজ এবং আগামীকাল থাকিবে, তখন আর ভাবনা কী? একটি দিন নষ্ট হলেও আরাে ঢের দিন পড়ে রয়েছে- এরূপ ধারণা আমাদের কাছে ব্যর্থতাকে বয়ে নিয়ে আসে।

নিরবচ্ছিন্ন সময় প্রবাহ চলেছে, মানুষের জীবন তারই মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয় পেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের বিরাট প্রবাহের তুলনায় মানুষের আয়ু খুব সামান্য-‘স্বল্পং আয়ুঃ বহবশ্চ বিদ্যাঃ’।

দৈনন্দিন জীবন ও সময়

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সময়নিষ্ঠতার গুরুত্ব যথেষ্ট। কি ছাত্র, কি ব্যবসায়ী, কি চাকুরিজীবী, কি গৃহকত্রী সকলেরই সময়ানুবর্তী হওয়া উচিত।

তা না হলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। জীবনকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও লক্ষ্যাভিমুখী করতে হলে সকলকে সময়নিষ্ঠ হতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে যখনকার কাজ তখন করতে হয়, নতুবা সাফল্য আসে না।

পৃথিবীর উন্নত দেশে তাই সময়নিষ্ঠতার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করা হয়।

সময়ের সদ্ব্যবহারে জীবনের সার্থকতা

সাধারণত আমাদের আয়ুষ্কাল ষাট থেকে সত্তর বৎসর।

হিসাব করলে দেখা যাবে,-তার এক-তৃতীয়াংশ কালই আমরা ঘুমাইয়া কাটাই ; স্নানে-পানে- আহারে, রােগে-শােকে, আমােদে-উৎসবে-বিলাসেও আমাদের বহু সময় ব্যয়িত হয়।

জীবনের খাতায় জমার অঙ্কে যে-সময় লেখা আছে সেখান থেকে আমাদের সময়ের হিসাব বাদ দিয়ে দি তাহলে সামান্য কয়েক বছরের অঙ্কই বাকি থাকে। সেই অঙ্কের যথাযথ ব্যবহারেই আমাদের জীবন জ্ঞানে ও কর্মে সার্থক হয়ে উঠতে পারে।

ছাত্র জীবনে সময়ের গুরুত্ব

ছাত্রজীবনে সময়ের গুরুত্ব যথেষ্ট। কেননা ছাত্রজীবন একটি নির্দিষ্ট অধ্যায় মাত্র।

সেই সময় চলে গেলে আর তা ফিরে আসে না বা তাকে পুনরুদ্ধার করা যায় না। ছাত্রজীবনে একটি নির্দিষ্ট সূচি ও সময় মেনে এক শ্রেণি থেকে আর এক ছাত্রজীবনে একটি নির্দিষ্ট সূচি ও সময় মেনে এক শ্রেণি থেকে আর এক শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হয়।

তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পড়াশােনা করতে হয় বলেই সময়ের এত গুরুত্ব এবং সময়কে গুরুত্ব দিলে সাফল্যও আসে।

বিশেষ করে সারা বছরের পড়াশােনা তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় যখন যাচাই করা হয়, তখন সময়কে গুরুত্ব না দেওয়া বােকামির কাজ। তাই ছাত্রজীবনে নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে সময়কে গুরুত্ব দিলে ছাত্রজীবনের সাফল্য অবধারিত।

সময়ের সদ্ব্যবহার শিক্ষার কাল ছাত্রজীবন

সমাজের সকল স্তরের লােকের পক্ষেই সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন হওয়া আবশ্যক।

কখন কোন্ অতর্কিত মুহূর্তে-যে উহা আমাদের চিত্তক্ষেত্রে সুবৃষ্টি বর্ষণ করে যায়, সে-সম্পর্কে অবহিত না থাকিলে আমরা উপযুক্তকালে বীজও বপন করতে পারি না এবং সিদ্ধির ফসলও ঘরে তুলতে পারি না।

এ বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্ব সর্বাপেক্ষা গুরু। কারণ, ছাত্রজীবনই সকল কিছু শিক্ষার কাল, সময়ের মূল্য শিক্ষারও কাল। কাদা শুকিয়ে শক্ত হলে আর সেটিকে ইচ্ছানুরূপ আকার দেওয়া চলে না।

অধিকন্তু, যে-ছাত্র বা যে-ছাত্রী সময়ের সদ্ব্যবহার করে না, পরীক্ষায়ও সে কোনােদিন সাফল্য লাভ করতে পারে না। মহাকবি মধুসূদন অনেকগুলি ভাষা জানতেন শুনে আমরা বিস্মিত হই।

এই জ্ঞানের চাবিকাঠিই ছিল সময় সম্বন্ধে তীক্ষ মূল্যজ্ঞান। তার কর্মব্যস্ত জীবনেও তিনি এক-একটি বিষয় শেখবার জন্য বিশেষ সময় নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিলেন। উহারই সদ্ব্যবহারের ফলে তিনি এতগুলি ভাষায় পারদর্শী হইয়াছিলেন।

সময়নিষ্ঠার অভাব

আমাদের বাঙালি জীবনে সময়নিষ্ঠতার অভাব যথেষ্ট। আমাদের মধ্যে একটা গয়ংগচ্ছ ভাব, গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসানাে। তাই পঙক্তি ভােজনে আমাদের ভুক্তাবশিষ্ট-ই ভাগ্যে জোটে।

আমরা এতই অলস ও কৃত্রিম যে সময়কে গুরুত্ব না দিয়ে ঠকি। ঠকে সেই ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ আখ্যা দিয়ে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করি।

অথচ যে সময়চেতনার অভাবে যে সময়ে যে কাজটা করা উচিত ছিল, তা না করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পরে এ ধরনের উক্তি করে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা তাে এক ধরনের ভাড়ামি।

সময়ই সম্পদ

‘অনেকে বলে থাকেন, “Time is money.” উক্তিটি যথার্থ। যে-মুহূর্তটির আমরা সদ্ব্যবহার করি, সেই মুহূর্তটিই আমাদের জীবনে সার্থক । তার অর্থ এই নয় যে, সময়ের সদ্ব্যবহার করলেই আমাদের পকেট টাকায় ভরে ওঠে।

এর অর্থ এই যে, সময়ের সদ্ব্যবহার দ্বারা আমরা যে-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করি, ভবিষ্যতে সেটাই আমাদের জীবনে অর্থকরী হয়ে ওঠে। জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য ও ঐরূপ জ্ঞানের প্রয়ােজন হয়।

উপসংহার

সময়কে মূল্য দিয়া ক্রয় করা যায় না- ইহা অমূল্য ; সময় ও স্রোত কাহারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ানুবর্তিতার অভাবে আমাদের জীবনে কেবলমাত্র হাহাকার ধ্বনি শােনা যায়।

মানব- জীবনে সময়ের গুরুত্ব অসাধারণ। যারা জীবনে বড় হয়েছেন, সেই সব মহাপুরুষদের জীবনে সময়ের মূল, ছিল খুব বেশী।

তাদের জীবনে সময়ানুবর্তিতা ছিল বলেই তারা জীবনে বড় হতে পেরেছিলেন। সময় অনুযায়ী কার্য করিলে জীবনে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।

যথাসময়ে বীজ রােপণ না করিলে যেমন ঠিকমত ফল পাওয়া যায় না, তেমনি যথাসময়ে কর্ম সম্পাদন না করলে কার্যফল লাভে বঞ্চিত হতে হয়।

আমাদের জীবন গতিময়। এই গতিময় জীবনে সময়ের হাত ধরে পথ চলতে না পারলে সে জীবন অনাবাদী থেকে যাবে, তাতে আর সােনার ফসল ফলবে না। তাই সময়ানুবর্তিতা হল জীবনে সাফল্যের অন্যতম দিক।

আমাদের সমাজে সফল পুরুষরা জীবনে সাফল্য পেয়েছেন সময়কে কাজে লাগিয়ে। শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, জাতীয় জীবনের ইতিহাসে সময়ের গুরুত্ব যথেষ্ট।

যে কোনাে প্রগতিশীল জাতি ও মানুষের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি হল সময়ের প্রতি মর্যাদাবােধ।