স্বাবলম্বন নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা লেখ

ভূমিকা

পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের কাজ নিজের চেষ্টায় ও যত্নে সম্পন্ন করার নামই স্বাবলম্বন। মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য যে-সকল গুণের অনুশীলন অতি অতি আবশ্যক , স্বাবলম্বন তাদের অন্যতম।

স্বাবলম্বী হওয়ার অর্থই হল বেঁচে থাকার যােগ্যতা অর্জন করা। স্বাবলম্বনের পথেই জীবজগৎ বেঁচে থাকতে পারে।

স্বাবলম্বন কী

নিজের কর্মের দ্বারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানাে হল স্বাবলম্বন। কেউ পায়ে হাঁটতে পারলে হাঁটার জন্য লাঠি নেয় না, চোখে দেখতে পেলে কেউ চশমা চোখে দেয় না।

অর্থাৎ মানুষ নিজে নিজে চলবার শক্তি যে অর্জন করেছে, সেই শক্তি দ্বারা তাকে চলতে হয়, কারাের সাহায্য ছাড়া।

এই চলা হল স্বাবলম্বন। যখন মানুষ লাঠি নিয়ে চলে, তা হল মুখাপেক্ষিতা। প্রকৃতিতে একটি গাছ স্বাভাবিকভাবেই পরের সাহায্য ছাড়া বেড়ে ওঠে, স্বাবলম্বী মানুষও তাই।

বৈশিষ্ট্য

স্বাবলম্বন কোনাে বিশেষ গুণমাত্র নয়, বরং তা কয়েকটি সমন্বিত গুণের যােগফল।

একজন স্বাবলম্বী মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলি হল ও শ্রমের প্রতি নিষ্ঠা, সততা, আদর্শানুগত্য, শৃঙ্খলাবােধ, নিয়মানুবর্তিতা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, মিতব্যয়িতা ও পরােপকারের প্রতি আগ্রহ প্রভৃতি।

আলস্য ও উজ্জ্বলতা, অতিরিক্ত বাকপটুতা কখনােই স্বাবলম্বী মানুষের গুণ নয়। স্বাবলম্বী মানুষকে আগে কর্মী হতে হবে।

কারণ প্রকৃত কর্মের মাধ্যমে এবং নিরন্তর কর্মের মধ্যে থেকে একজন মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে।

ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে পরনির্ভর দিক

প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ কি তার জীবনধারণের জন্য সকল প্রয়ােজনীয় বস্তুই আপনি আয়ত্ত করতে পারে? ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাে শিশুকে মাতাপিতার মুখাপেক্ষী হতে হয়, শিক্ষাজীবনে শিক্ষকের উপর নির্ভর করতে হয়।

মানুষ সামাজিক জীব, সমাজের মানুষের মুখের দিকে তাকে চেয়ে থাকতে হয়।

আমি আমার বস্ত্র নিজে বয়ন করিতে পারি না, ক্ষুধার অন্নের জন্য শস্যোৎপাদনও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, বাসগৃহের জন্য মিস্ত্রী-মজুরের শরণাপন্ন আমাকে হতেই হয়। তবে স্বাবলম্বনের অর্থ কী?

সাবলম্বনের প্রকৃত অর্থ

সত্য বটে, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, সমাজের উপর তাকে নির্ভর করতেই হয়। কিন্তু সেই সমাজ তাে নৈর্ব্যক্তিক একটা কোনাে বিষয় নয়। বহু ব্যক্তিকে মিলিয়েই সমাজের সৃষ্টি।

সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির নির্দিষ্ট করণীয় রয়েছে। সেইগুলিই প্রত্যেক ব্যক্তিকে যথাসাধ্য আপনার শক্তিতেই সম্পন্ন করতে হয়।

যে-সকল কাজ আমি নিজে করতে পারি, উহার জন্য অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকব কেন?

নিজের ক্ষমতা থাকতেও আমি যদি তার সদ্ব্যবহার না করিয়া অপরের মুখাপেক্ষী হই, তবেই আমি পরনির্ভর হইলাম। তার বিপরীতটাই স্বাবলম্বন।

অর্থাৎ যে-কাজ আমি নিজেই করিতে পারি, অপরের প্রত্যাশী না হইয়া সেই কাজ করার অর্থই স্বাবলম্বন।

স্বাবলম্বনের বিপরীত দিক

স্বাবলম্বনের বিপরীত দিক হল পরনির্ভরতা। এই পরনির্ভরতা যান্ত্রিক বস্তুবাদী যুগের অন্যতম যুগলক্ষণ। বস্তুবাদী যুগে অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা ও বস্তুর প্রতি মােহ মানুষের কর্মস্পৃহাকে কমিয়ে দেয়।

বস্তুগত ভােগসুখ আত্মিক সুখের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই আজকের শিশু-কিশােরদের কাছে। তার বাবা-মা অন্ধের যষ্টির মতাে। অভিভাবকের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের জীবনের লক্ষ্য, কর্মপন্থা নির্দিষ্ট হয়।

তাদের হাতের কাছে ধরিয়ে দেওয়া হয় ‘রেডি রেকনার’, মাথা খাটিয়ে, শ্রম দিয়ে অর্জন করার বিষয়টি তাই শিশু-কিশােরের কাছে অনভিপ্রেত।

তাছাড়া শিশু-কিশােররা আজকাল প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হওয়ায়, তাদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, শ্রমের প্রতি নিষ্ঠা আসছেই না। তারা হয়ে যাচ্ছে অলস ও পরমুখাপেক্ষী।

স্বাবলম্বী মানুষ গড়ে তুলতে তাই এই আলস্য ও পরমুখাপেক্ষিতা প্রধান অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

শুধু তাই নয়, আজকাল ছাত্র-ছাত্রীরা যেভাবে টিউশান এবং কোচিং নােটের উপর আস্থাশীল হয়ে পড়ছে, তাতে তারা প্রচুর নম্বর পেলেও নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে তাদের জ্ঞানের পরিধি যে বাড়ছে না তার কারণ স্বাবলম্বনের অভাব।

একজন হাউসস্টাফ ডাক্তারকে তার প্রফেসারকে বলতে শুনেছিলাম, তাদের পরীক্ষার বছর যেহেতু ‘অ্যাপেন্ডিসাইটিস’ ইম্পরট্যান্ট ছিল না, তাই সে তা পড়েনি। এই হল পরনির্ভরতার নমুনা।

শৈশবই স্বাবলম্বন অনুশীলনের প্রশস্ত কাল

অন্যান্য বৃত্তির মতাে স্বাবলম্বনেরও অনুশীলন করতে হয়। তার অনুশীলনের প্রারম্ভিক প্রশস্ত কাল হল শৈশব। স্কুল-জীবন হতেই এই সৎ গুণটির চর্চা করতে হয়।

যে-ছাত্র শৈশব হতেই পড়াশোনার জন্য সম্পূর্ণরূপে শিক্ষক বা গৃহশিক্ষকের উপর নির্ভর করে, তাহার বুদ্ধিবৃত্তির কখনও সম্যক বিকাশ হতে পারে না। আত্মশক্তির উপর সে বিশ্বাস হারাইয়া ফেলে।

ফলে সে কোনােদিন মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিতে পারে না। জগতে যাহারাই প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, শৈশবে শিক্ষাবস্থায় তারা কখনও শিক্ষকনির্ভর হইয়া থাকেন নাই।

দৃষ্টান্তস্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছাত্র-জীবনের উল্লেখই এখানে যথেষ্ট।

প্রত্যেক ছাত্রকে তাই স্বাবলম্বী হতে হবে, অন্তর্নিহিত শক্তির প্রেরণায় অধ্যয়নে রত হইতে হইবে, শিক্ষক কেবল সেই শক্তির মূলে অনুপ্রেরণা যােগাইবেন। শুধু ঈশ্বরচন্দ্রই নন, পৃথিবীর অনেক প্রতিষ্ঠাবান্ ব্যক্তির জীবনে সাফল্য লাভের মূলই স্বাবলম্বন।

ছেলেবেলা থেকে  যারা নিজের উপর নির্ভর করতে শিক্ষা- লাভ করেনা ভবিষ্যৎ জীবনে তারা যদি জাতির কর্ণধার হয়ে থাকে, তাহলে সেই জাতিকে নিশ্চয়ই পরের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হবে।

কিন্তু একথা সত্য যে, যে যারা নিজের পায়ের উপর দাড়িয়ে উন্নতি করতে পারে না-তারা কখনওই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বলে নিজের পরিচয় দিতে পারবে না।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির দিকে তাকালে আমরা লক্ষ্য করি যে তাদের কখনােই অপরের উপর নির্ভর করে না। শত দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করিয়াও নিজেরা নিজেদের দেশের সম্পদ হতে নিজেদের উন্নতি করতে পেরেছ।

স্বাবলম্বন পথের বিঘ্ন

আলস্য ও জড়তা স্বাবলম্বন-পথের প্রধানতম বাধা।

অনেক সময় আলস্যবশতঃও আমরা নিজের কাজটি করিতে পারি না। বিশেষতঃ একান্নবর্তী পরিবারে এই ত্রুটি বহুল পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়।

মাথার উপর বাবা আছেন বা দাদা আছেন, এই ভাবে অনেকেই বৃথা কর্মে দিন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়। ইহার ফলে স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদ এসে আমাদের অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

পরিবারের প্রতি আমারও-যে কিছু কর্তব্য আছে, তা ভুলে যাই বলেই পরিবারে ভাঙন ধরে। একমাত্র স্বাবলম্বনই এই ভাঙনকে রােধ করতে পারে।

শক্তি অনুযায়ী কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা সকলেরই আছে, চেষ্টা করলে সকলেই প্রতিষ্ঠাবান্ না হােক, পরিবারকে, সমাজকে আপনার কর্ম দ্বারা পরিপুষ্ট করতে পারে।

ব্যক্তিগত শিক্ষার মূল লক্ষ্য সেটাই। আমার ব্যষ্টিজীবনের কর্মকে আমি সমষ্টিজীবনের সামাজিক কল্যাণের অভিমুখী করে তুলব, ইহাই শিক্ষার লক্ষ্য, মানব-জীবনেরও লক্ষ্য।

সেই লক্ষ্যসাধন করিতে গেলে সততার সঙ্গে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করিতে হয়। এইখানেই স্বাবলম্বনের সার্থকতা।

জাতির পক্ষে স্বাবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা

ব্যক্তির পক্ষে যা সত্য, জাতির পক্ষেও সেইটাই সত্য। যে-জাতি স্বাবলম্বী নয়, সে-জাতি কেবল পশ্চাতেই পড়িয়া থাকে না, কালধর্মে জাতি হিসাবেই নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়।

পরমুখাপেক্ষী জাতিকে পদে পদে লাঞ্ছিত ও বিড়ম্বিত হতে হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতবর্ষের কথাই ধরা যাক। বিদেশী শাসনে আমরা সর্বতােভাবে পরনির্ভর হয়ে ছিলাম। তার একটা কারণও ছিল।

কিন্তু আজিকার স্বাধীন ভারতেও যদি আমরা জাতির সর্বাপেক্ষা প্রয়ােজনীয় বিষয় খাদ্য ও শিল্প উৎপাদনে পরদেশের মুখ চেয়ে থাকি, তবে আমাদের দৈন্যদশা কখনও ঘুচবে না।

দেশে কৃষির উন্নতি-বিধান না করিয়া যদি আমরা কেবল বিদেশ হতেই খাদ্যশস্য আনতে থাকি, তবে সেটি একটা অভ্যাসে পরিণত হবে এবং সেই পরনির্ভরতার ছিদ্রপথে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাবে, আর ভারতবর্ষ চিরন্তন দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে থাকবে।

এক্ষেত্রে আমরা যদি স্বাবলম্বী হয়ে প্রয়ােজনীয় খাদ্য নিজের দেশেই উৎপন্ন করিতে অগ্রসর হই, তবেই সেই সর্বনাশা বিপদ হতে পরিত্রাণ পেতে পারি। এইভাবেই দেখা যায়, জাতীয় ক্ষেত্রেও স্বাৰলঙ্গন অপরিহার্য।

উপসংহার

যে-স্বাবলম্বী সে ব্যক্তিই হােক, আর জাতিই হােক, তার মধ্যে গভীর আত্মপ্রত্যয় বিদ্যমান থাকে। সেই প্রত্যয়ের বলেই সে শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে।

সে জানে যে, আমার কাজ আমিই করতে পারব, অপরের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি আমাকে করতে হবে না। ভিক্ষাবৃত্তি দীনতার সূচক। সে জানে, যারা নিজেদের সাহায্য করে, কেবল তাহারাই ভগবানের সাহায্য পায়।