নদীর তীরে বনভোজন করার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

চলমান এই জীবনস্রোতে আমরা বেশিরভাগ সময়ই নিত্য-নৈমিত্তিকতা, প্রথাবদ্ধতা এবং দিনযাপর্নের গ্লানির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করি।

তাই জীবনে মুক্তির আনন্দ পেতে কে না চায়? যদি সেই আনন্দ কোনাে নদীর ধারে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বনভােজন হয় তাহলে তাে কথাই নেই।

গত বড়দিনের ছুটিতে রূপনারায়ণের তীরে কোলাঘাটে বনভােজনের আনন্দ ও অভিজ্ঞতা আমার কাছে দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রস্তুতি

বড়দিনের ছুটির একটা মজা আছে। কেননা তখন পরীক্ষা হয়ে গেছে এবং শীতের আমেজ, নলেন গুড়ের সৌরভ, খেলাধুলা প্রভৃতি সবকিছু নিয়ে একটা আলাদা আনন্দের অবসর।

সেই অবসরে আমরা আমাদের বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম সবাই মিলে বনভােজন করব।

কিন্তু অভিভাবকদের সম্মতি আদায়ের প্রয়ােজন। দেবাঞ্জন বলল, ওটা আমার উপর ছেড়ে দে, ওটা আমি সবার বাড়িবাড়ি গিয়ে ম্যানেজ করব। হলও তাই, ওকে সকলের বাবা-মা খুব ভালবাসেন।

তাই সম্মতি মিলে গেল। এরপর স্থান নির্বাচন। কেউ বলল বকখালি, কেউ বলল ডায়মণ্ডহারবার, কেউ বলল কোলাঘাট।

আমরা হাওড়ার ছেলে বলেই সামনে কোলাঘাটকেই বেছে নিলাম যাওয়া আসা কম সময়ের মধ্যে হবে ভেবে।

স্থির হল, একটা গাড়ি ভাড়া করে রান্নার সাজসরঞ্জাম প্রভৃতি নিয়ে ৩১ ডিসেম্বর কোলাঘাটে নদীর ধারে বনভােজনের জন্য যাব।

প্রাথমিক পর্ব

যথারীতি ২৮ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আমরা একসঙ্গে কুড়িজন বন্ধু কোলাঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

বাসের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল গান, হৈ-হুল্লোড়। হৈ-হুল্লোড় কিছুটা কমল, টিফিনের প্যাকেট পেয়ে।

ইতিমধ্যে গাড়ি পৌঁছে গেল কোলাঘাটের নদীর চরে।

শতরঞি পেতে তার উপর রান্নার জিনিসপত্র রেখে আমরা একটু নদীর কাছে ঘুরে নিলাম। ঠিক করা হয়েছিল নিজেরাই রান্না করব। তাই সবাই মিলে যে যার কাজ ভাগ করে নিলাম।

সেই অনুযায়ী পেঁয়াজ ছাড়ানাে, আলু কাটা প্রভৃতি যে যার কাজ করতে শুরু করল।

পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছিল সুমন, চোখে জল আসতেই সে কাজটা ছেড়ে দিল। দেবাঞ্জন তখন বলল, তােকে কিছু করতে হবে না, তুই বােস, আমি ওটা করে দেব।

রান্নার দায়িত্ব নিয়েছিল সৌরভ আর দীপ্র। দুজনে জামা প্যান্ট খুলে হাফ প্যান্ট পরে মাংস কষার কাজে লেগে গেল। এদিকে নদীর চরে আমরা কয়েকজন মিলে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু করে দিলাম।

এদিকে একটি জেলে ডিঙি মাছ ধরে ফিরল সঙ্গে কয়েকটি রূপনারায়ণের ইলিশ। বাজারে তাে টাটকা ইলিশ দেখা যায় না, টাটকা ইলিশ দেখে মনটা পুলকিত হল।ইতিমধ্যে চালানদাররা এসে ইলিশ নিয়ে চলেও গেল। মনের মধ্যে আশা ছিল বাড়ির জন্য ইলিশ মাছ একটা নিয়ে যাব, তা আর হল না।

খাওয়ার পর্ব

এদিকে রান্নার পর্ব প্রায় শেষের পথে। মাছ দেখে আমরা যখন কয়েকজন ফিরে আসি তখন দু-তিন জন মাংস মুখে দিয়ে রান্না কেমন হয়েছে পরখ করছে, আমরাও লােভ সামলাতে পারলাম না।

দুটো নাগাদ সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম। সৌরভ ও দীপ্র সবাইকে পরিবেশন করছিল, ওদের পাতাও পাতাই ছিল- সবাইকে দিয়ে ওরাও খেতে বসে গেল।

কেউ বলল ঝাল হয়ে গেছে, কেউ বলল নুন বেশি হয়েছে, তবে সবাই চেটেপুটে খেল।

শেষকালে ভাত কম পড়ে গেছে, ভাত চেয়ে আর পেল না। একসঙ্গে বসে এমন উন্মুক্ত নদীর চরে খাওয়ার আয়ােজনে খিদেটা একটু বেশি বেড়েই গিয়েছিল।

এরপর নদীবক্ষে নৌকা ভ্রমণ। সবাই মিলে নৌকায় করে প্রায় এক কিমি নদীপথ অতিক্রম করলাম। প্রথমে ভয় ভয় করলেও সে যে কী আনন্দ তা বুঝিয়ে বলা যায় না। নৌকা ভ্রমণ থেকে ফিরে এসেই আবার খিদে পেয়ে গেল।

অথচ বাড়িতে থাকলে মা পেছন পেছন খাওয়াবার জন্য কতই না কাকুতি-মিনতি করেন। আর এখন ভাবতে খুব ভাল লাগল। বুঝলাম এরকম একটা আয়ােজনের কত প্রয়ােজন ছিল।

উপলব্ধি করলাম, এই বনভােজনের আনন্দ অকৃত্রিম আনন্দ- প্রাণভরে আনন্দ করা যায়, আনন্দ দেওয়াও যায়। মায়ের হাতের বা ঠাকুরের হাতের রান্না নয়, একেবারে নতুন অনভিজ্ঞের হাতের রান্না কোন্ গুণে এত সুস্বাদু হয় তাও বুঝলাম।

উপলব্ধি

উপলব্ধি করতে শিখলাম, শুধু ভােগের মধ্যে আনন্দ নেই, ভাগের মধ্য দিয়ে ভােগের মধ্যেই রয়েছে যথার্থ আনন্দ।

বিশেষ করে মুক্ত প্রকৃতির কোলে, নদীর চরে সকলে একসঙ্গে মিলিত হয়ে পরস্পর ভাব ও আচরণ আদান-প্রদানের এই যে ক্ষেত্র তা আর কোথায় বা পাওয়া যেতে পারে?

উপসংহার

নদীতীরে বনভােজনের এই আনন্দ সহজ, পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ আনন্দ।

এই বনভােজন তাে উদর পূর্তির জন্য নয়, তা মনের খােরাক বৃদ্ধি করে। যাইহােক সবাই মিলে গাড়িতে করে ফিরে এলাম যে যার বাড়িতে। শুধু পড়ে থাকল স্মৃতি। স্মৃতি বড়ই ব্যাকুল করে তােলে এখনাে।