ভূমিকা
মানুষের জীবন অন্তহীন পথচলা। পথের প্রান্তে যে পরম রয়েছে তার জন্য অন্তহীন অভিসার মানুষের।
তবুও মানুষের জীবনের সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত কোনাে লেখক দিতে পারেনি,এ এক আশ্চর্য জিনিস। যেন নৌকায় করে এ এক অনন্ত সমুদ্র যাত্রা।
শৈশবে যখন পৃথিবীর বুকে পা রেখেছিলাম জানতাম না জীবন কি-এ যেন এক রহস্যের সিন্দুকের মতাে ছিল আমার কাছে। বেশ মনে পড়ে শৈশবের কথা যখন পরীক্ষার পরে একলা বারান্দায় বসে থাকি।
রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করে, পাশেই কৃষ্ণচূড়া গাছ-কখনাে সে যেন লাল চাদরে নিজেকে মুড়ে নেয়। তখন মনে ভেসে আসে শৈশবের কথা-যেন ভুলে যাই আমি কোথায় আছি।
- আমাদের বিদ্যালয়ের রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব
- ছাত্রছাত্রীদের চরিত্র গঠনে খেলাধুলার গুরুত্ব রচনা
- মানব জীবনে সময়ের মূল্য ও গুরুত্ব
- ছাত্র জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে বাংলা রচনা
শৈশবের স্মৃতি
মায়ের মুখে শুনেছি আমার শৈশবের কথা-ছবিও দেখেছি। সারাদিন যেন বাড়িতে আমার রাজত্ব চলত! খেলার মধ্যে ছিল না বেশি কিছু-একটা সাইকেল, বল-এই যথেষ্ট ছিল।
মন বসত না কিছুতেই, খালি এদিক-ওদিক তাকাতাম, জানালার বাইরে, খাটের তলায়। খাটের তলাটা যেন আমার কাছে কি রকম রহস্যে ভরা ছিল।
প্রায়ই মনে পড়ে, আমি গুড়ি মেরে খাটের নীচে কি খুঁজতাম। পড়াশােনা করতাম না বললেই হয়। যতটুকু মা জোর করে পড়াত-তখন তাে আর মাথায় পরীক্ষার চিন্তা ঘুরত না।
এখন সময় কতাে পাল্টে গেছে, আর তাে বাইরের দিকে তাকানাের ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করলেও সময় পাই না, পড়ার টেবিলে বােঝাই করা বই দেখে মনে শিহরণ জাগে।
আমরা প্রায়ই আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাই। মা বলে, সেখানে গেলে নাকি আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সারাদিন-আমার যদিও মনে নেই।
বাবার সাথে বিকেলবেলা বেড়াতে যেতাম, আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা নদী, নদী বললে বেশি বলা হয়। ওটা কেবল একটা সরু জলের ধারা মাত্র।
বাবার হাত ধরে জল ছেটাতে ছেটাতে যেতাম আর মনে পড়ে শেওলা দেখে খুব ভয় পেতাম। বাবার বন্ধু নিতাই বাউল আমাকে কোলে বসিয়ে গান শােনাত; একটা গান আমার খুব ভালাে লেগেছিল-
“নদী ভরা ঢেউ বােঝে না তাে কেউ / কেন মায়ার তরী বাও বাও বাও রে।”
আগে মানে বুঝতাম না, কিন্তু এখন বুঝি। আমাদের আসল বাড়িতে সন্ধ্যাগুলি অন্যরকম কাটত।
বাবা কাজ থেকে ফিরলে বাবার বাইকের হেলমেট আর গ্লাভসগুলির প্রতি আমার বিশেষ এক আকর্ষণ ছিল, সেগুলি আকারে বেশ বড়াে হলেও গায়ে চাপিয়ে যি সারাবাড়ি আমার মনের গাড়ি চালিয়ে বেড়াতাম-এটাও মায়ের মুখে শােনা।
স্মৃতিচারণা
আমি ছােটোবেলায় অনেক কুকর্মও করেছি। অনেক বছর ‘জিয়ারডিয়াসিস রােগে ভুগেছিলাম। আবার খেলতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে দুবার মাথাও ফাটিয়েছি-একবার মা-বাবা আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।
এরকমই অম্লমধুর কতাে স্মৃতি এখনও মনে পড়লে নিজের মনেই হেসে উঠি। মা প্রশ্ন করে-“কিরে হঠাৎ পাগলের মতাে হাসছিস কেন?” আমি বলি-“কিছু না, এমনি।”
আবার প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন খুব কেঁদেছিলাম। এ আবার কোন্ জগতে চলে এলাম বাবা! আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি এই যান্ত্রিক জীবনযাত্রায়।
এখন-এখন আমি আর মানুষ নই, যন্ত্র হয়ে গেছি, নিজের মধ্যে সেই পনেরাে বছর আগেকার নিজেকে আর খুঁজে পাই না বলে কষ্ট হয় বটে।
বর্তমান জীবনে প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমানে ড্রয়িংরুমের কোণে রাখা বােকা বাক্সটির প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ লেগে থাকে শিশুদের।
এখন যতই তাদের বলা হােক না কেন- ‘জানলা দিয়ে আকাশটাকে দেখাে/ টিভি দেখাে না’—কে শুনেছে সে কথা! আকাশ মাথায় থাক, চোখের সামনে বরং থাক টিভি।
এই টিভি কালচার শিশুকে কৃত্রিম করে দিচ্ছে, স্লো পয়জনিং-এর মতাে কেড়ে নিচ্ছে শিশুর সূক্ষ্ম সুখানুভূতিগুলিকে, গুলিয়ে দিচ্ছে ভাব-ভালবাসা, শ্রদ্ধা-ঘৃণা, অনুরাগ-বীতরাগের বােধগুলিকে।
একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ায়, ফ্ল্যাট কালচার এসে যাওয়ায় পরিবারে বয়স্ক লােকেদের স্থান আজ আর নেই, তাদের স্থান বৃদ্ধাশ্রমে।
তাই শিশুদের কাছে দাদু-ঠাকুমার কোলে চেপে ‘আয় আয় চাদমামা’ শােলােক বলার মাধুর্য নেই, নেই শালােক বলার ‘কাজলা দিদি’, নেই রাজপুত্র, রাজকন্যা, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প।
আর রামায়ণের গল্পের কথা তাে দূর অস্ত। এখনকার সীতা মানে ঐশ্বর্য এবং রাবণ মানে অভিষেক।
উপসংহার
এই বর্তমান জীবন আমি ফেলে রেখে আবার অনুভব করতে চাই শীতের বিকেলে ঘন নীল রাত্রির পূর্বাভাষ, দুপুরবেলায় বিশ্বচরাচর মাঝে একাকিত্বের ছায়া, দেখতে চাই ফাল্গুনের তারা-ভরা আকাশ।
জীবনানন্দ যেমন রূপসী বাংলার মােহে আবার ধানসিড়ি নদীটির তীরে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, আমিও তেমনি ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচর্বণ করে ফিরে পেতে চাই আমার একান্ত প্রিয় দিনগুলিকে, একান্ত আপনার করে।
এভাবে স্মৃতিচারণার সূত্রে আমি আমার জীবনের পাথেয় সঞ্জয় করতে চাই।