ভূমিকা
সাহিত্য কথাটির সঙ্গে সহিতত্ত্ব বা পারস্পরিক সম্পর্কের যােগ নিহিত রয়েছে। প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রেও সাহিত্যকে ‘সহৃদয়-হৃদয় সংবাদী’ বলা হয়েছে।
সৃষ্টির আদিতে মানুষ শুধু নিজেকে জেনে সন্তুষ্ট হয়নি, অপরকেও জানাতে চেয়েছে।
এই জানানাের মধ্যে দিয়েই আনন্দ এবং সাহিত্যসৃষ্টির আদিমতম রূপ হল আনন্দ। আমাদের সংগীত, নৃত্যকলা প্রভৃতি সমস্তই নিজেকে অপরের নিকটে প্রকাশ করা যা আনন্দের মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত।
তাই সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার, একের সঙ্গে অন্যের বন্ধুত্ব পাতিয়ে সাহিত্য মানুষের মধ্যে আত্মীয়তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
এবং আজকের কর্মব্যস্ত বৈজ্ঞানিক যুগেও সাহিত্য সমান শক্তিতে আসীন।
একদিকে বহিঃপ্রকৃতি অন্যদিকে মানব হৃদয় ও মানব চরিত্র সাহিত্যিকের হৃদয়ে যে ঢেউ তুলেছে তার ভাষা রচিত রূপ হল সাহিত্য।
- অরণ্য ও অরণ্য প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রচনা
- এক স্বপ্নের উড়ান : এ পি জে আব্দুল কালাম রচনা
- বন্ধুত্বের গুরুত্ব রচনা
প্রয়ােজনীয়তা
সাহিত্য সুনির্বাচিত এবং আমাদের মন গ্রহণােন্মুখ হলে, তবে তা পাঠ করার মধ্য দিয়েই আমরা জ্ঞান অর্জন করি।
সৎ-সাহিত্য আমাদের সত্য উপলব্ধিতে সাহায্য করে, মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটায়; ন্যায়-অন্যায়, ভালাে-মন্দের বিচারে সহযােগিতা করে আমাদের প্রকৃত মুক্তি ও কল্যাণের পথে চালিত করে।
সাহিত্য পাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা জগৎকে জানি, জীবনের চাহিদা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হই এবং মানুষের মধ্যেই শিব ও রুদ্রের মিশ্রণ প্রত্যক্ষ করি।
তাই সাহিত্য পাঠ শুধু ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তি সাধনই করে না, সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা সমকালীন মানুষকে, অতীত জীবনধারাকে যেমন জানি, তেমনি বিদেশি সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে অন্যদেশের জীবনচর্যা আমাদের চিত্তদর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়।
জীবন ও সঙ্গী
সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় :
- এক, সমসাময়িক কালে কাছের বা দূরের মানুষকে যেমন জানা যায়, তেমনি আমাদের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা অনাগতকালের জন্য লিপিবদ্ধ করে রাখি।
দুই, সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামাজিক জীবন, তার সংস্কার ভাবনা, রীতি-নীতি সবকিছুকেই প্রকাশ করি। - এছাড়া, আমাদের চিত্ত যখন আবেগে আকুল হয়, শশাকে বা বিরহে মুহ্যমান হয়, সঙ্গীহারা চিত্ত যখন সঙ্গ প্রত্যাশা করে, তখন সাহিত্যই একমাত্র নির্ভরযােগ্য সঙ্গী-কারণ সে সঙ্গী কখনও ছলনা বা বিশ্বাসঘাতকতা করে না। সেদিক থেকেও সাহিত্য পাঠের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।
সমাজ দর্পণ
সাহিত্য আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। সাহিত্য সমকালীন জীবন ও সমাজের দর্পণ।
আমরা সমাজে বাস করি। সমাজের মধ্যেই আমরা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সূত্রে গ্রথিত।
এই সংযােগসূত্র সাহিত্যে ফুটে ওঠে।
সুতরাং সাহিত্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা জ্ঞান আহরণের সুযােগ পাই, তেমনই অন্যদিকে নানা অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে মানবজ্ঞানের বিচিত্র ভাবনাকে প্রকাশ করি।
বিজ্ঞান শুধু তথ্য দিলেও সেই তথ্যকে বাস্তবায়িত করে সাহিত্য।
আর এই বাস্তবায়ন থেকেই আনন্দ। এবং এই আনন্দই সাহিত্য পাঠের অপরিহার্য অঙ্গ।
সামাজিক দলিল
সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে নানা দেশ ও জাতিকে জানার সুযােগ ঘটে, সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সৎ-সাহিত্য হল সামাজিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার দলিল।
সাহিত্যে থাকে সামাজিক মানুষের মিছিল, গণদেবতার পদধ্বনি। সমাজে যারা নিঃস্ব, অবহেলিত ও লাঞ্ছিত,সাহিত্য তাদেরও সম্মান দেয়। নানা জাতের মানুষ সাহিত্যে নানাভাবে ভীড় করে।
সাহিত্য তাদেরকে একত্রে জড়াে করে জীবনের ছবি আঁকতে ব্যস্ত। সে ছবি কথা শিল্প বা নাট্য সাহিত্যে ফটোগ্রাফ-এর কাছাকাছি, কিন্তু কবিতায় বা গানে তা শিল্পীর হাতে আঁকা ও কল্পনায় রাঙানাে রঙ-বেরঙের চিত্র।
কল্পনাশক্তির বিকাশ
কল্পনাশক্তির বিকাশও সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে হয়। চিত্রধর্মী বর্ণনা বা বিশ্বাসযােগ্য চরিত্রের সান্নিধ্য আমাদের ভিন্ন জগতের মানুষ করে তােলে।
যেমন, কল্পনায় কত ফুলের সুবাস পাই, কত মানুষের উয়শ্বাস অনুভব করি-কল্পলােকের ঘটনার আবর্তে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতাে কবি শিল্পীদের সুরে সুর মিলিয়েও অনেক কথা বলি। জীবনী-সাহিত্য পাঠের মধ্যে দিয়ে অনন্যসাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে।
কখনও বা প্রতিভার দীপ্ত স্পর্শের চমক, আবার কখনও বা বিরাট ব্যাপ্তিকে ঘিরে অসীম অনন্তের বার্তা।
আত্মজীবনী বা ভ্রমণ সাহিত্যও সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে সম্ভব।
যেমন, ভ্রমণ সাহিত্য আমাদের মানস ভ্রমণের সহায়ক, বিচিত্র এই সাহিত্য পড়লে আমরা বিপদসঙ্কুল পর্বতের পথ ধরে অভিযান, কত সময় ঐশ্বর্যময় মহানগরীর রূপ বৈভব দেখতে দেখতে বিস্মিত হই।
অবসরের সঙ্গী
বিভিন্ন বয়সে সাহিত্য পাঠ বিভিন্নভাবে উপকৃত করে। শিশু রূপকথা ও উপকথা পড়ে কল্পনার খােরাক পায়, আনন্দ লাভ করে। কিশাের খোঁজে ডিটেকটিভ ও অ্যাভেঞ্জার বিষয়ক রচনা।
সন্দেহ নেই, এই শ্রেণির রচনা তরুণদের কাছে উত্তেজনা লাভের আকর্ষণীয় উপকরণ, বয়সােচিত কিছু প্রবণতার খােরাক।
বস্তুত তরুণ-তরুণীরা সাহিত্য থেকে যেমন প্রেমের পাঠ গ্রহণ করে, তেমনই পরিণত বয়সের পাঠকরা সাহিত্যের মধ্যে বিশ্রাম খোঁজে।
যেমন, একটি শিশু যেখানে ঠাকুরমার ঝুলি পড়তে পড়তে দুপুর কাটায়, অন্যদিকে একজন প্রবীণ সেখানে গল্প বা উপন্যাস পড়ে অবসর সময় অতিবাহিত করে।
উপসংহার
সর্বোপরি সাহিত্য আমাদের দুঃখে সান্ত্বনা, অবকাশে সঙ্গী, সংশয়ে পথপ্রদর্শক এবং সমস্যা বিচারে নৈয়ায়িক ও সংস্কারে যােদ্ধা।
সাহিত্য পাঠ আমাদের হৃদয়কে প্রস্ফুটিত করে, মনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে এবং বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণ করে।
সাহিত্য বাস্তব জগতের সীমানা ছাড়িয়ে এক অসীমের ইশারা ফুটিয়ে তােলে।
জীবনের নতুন মূল্য আমরা অনুভব করি সাহিত্যের অবারিত দানে। তাই মনে হয়, জীবনে অশান্তি ও দুঃখ যত বাড়ছে, সাহিত্য পাঠ তত জনপ্রিয় আকার ধারণ করছে।
এবং তার উপযােগিতাও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। বর্তমানের নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন জীবনে সাহিত্য পাঠের প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধ হচ্ছে।