একটি বেকার যুবকের আত্মকথা রচনা

সূচনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, বাড়ির বড় ছেলে আমি এক বেকার যুবক। আমি আমার কাছেই এক বােঝা- বাড়ির কাছে তাে বটেই। আমি যেন সৃষ্টিকর্তার এক হতশ্বাস- অপচয়ের গ্লানি। শুধু বিধাতা কেন, বাবা-মা, ভাই-বােন, বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছে আমি অপাঙক্তেয়।

কেননা আমি কোনাে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারিনি-আমি নাকি এক অপদার্থ। সেই অপদার্থতাকে ঘিরে আজকের এই বেকার যুবকের আত্মকথার রােজনামচা-তা যেমন ব্যথায় কাতর তেমনি বেদনায় বিধুর।

কৈশােরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন

আমার বাবা ছিলেন এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামান্য কেরাণী। আমরা পাঁচ ভাই-বােন। আমি বড়।

অনেক আশা নিয়ে আমাকে বাবা শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।

তাঁর সমস্ত চেষ্টার পিছনে ছিল একটি উদ্দেশ্য, আমি সংসারের হাল ধরি। সেই হাল ধরার জন্য বাবা আমাকে সবদিক থেকে সাহায্য করেছেন।

বাবা নিজে জানতেন, ইংরেজি শিখলে কাজ জুটে যাবে। সেই আশায় প্রাথমিক স্কুলে আমাকে না পড়িয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেন।

শুধু স্কুলে নয়, বাড়িতে একজন শিক্ষক রেখে সেই সময় থেকে পড়িয়েছেন। তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করেন।

মাধ্যমিকে আমি স্টার পাই। এরপর উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হই কলেজে।

তখন বাবা আগের মতােই প্রাইভেট টিউটর দিয়েছেন। বাবার ইচ্ছা ছিল আমি জয়েন্ট এন্ট্রাস-এ ভালাে ফল করে ডাক্তার হই।

কিন্তু জয়েন্টে সেই রাঙ্কিং আমি পাইনি। এমনকি উচ্চ-মাধ্যমিকে প্রথম শ্রেণি পেলেও ভালাে কলেজে স্থান না পেয়ে বাড়ির কাছে কলেজে বি. এস. সি. (পাশ) তে ভর্তি হই এবং পাশও করি যথারীতি।

চাকরির সন্ধান

বাবা ততদিনে অবসর নিয়েছেন। মা অসুস্থ, বােনের বিয়ের যােগাযােগ হয়ে ওঠেনি অর্থের অভাবে। কারণ, বাবার আয়-ব্যয় ছিল তুল্যমূল্য। তাই সঞ্চয়ের ভাড়ার ছিল প্রায় শূন্য।

তাই মা-র অসুখের জন্য ঋণ করতে হয়েছে বাবাকে। বােনের বিয়ে তাে দূর অস্ত। এখনাে ছােটো ভাই দুটো স্কুলে পড়ে। তাদের খরচও রয়েছে। তাই আমার উপর সকলেই আশা করে বসে আছে। শুরু হল চাকরির সন্ধান।

দুবার এস.এস.সি দিয়েও শিক্ষকতার চাকরি পেলাম না।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হন্যে হয়ে ঘুরেছি- কোনাে না কোনাে অজুহাতে বিফল হয়েছি। প্রাইভেট টিউশান করে যে কটা টাকা পাই তা ইন্টারভিউ দিতেই শেষ হয়ে যায়।

আবার টিউশানও চাকরি খুঁজতে গিয়ে বাড়াতে পারিনি। এভাবেই চলতে থাকে দু-বছর। এদিকে বাবার সঞয় ফুরিয়ে যায়, মহাজনের কাছে ঋণের দায়ে বাঁধা পড়তে হয় তাঁকে।

স্বপ্নভঙ্গ

কথায় আছে, ‘ছিদ্রেষু অনর্থা বহুলী ভবন্তি’ অর্থাৎ যখন বিপদ আসে তখন অনেক বিপদ একসঙ্গে আসে। আমার স্বপ্নভঙ্গের পালা সেখানেই শুরু যখন অর্থাভাবে আমার মা-কে হারাতে হয়।

তখন বহু প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি সামান্য টাকায় একটি চাকরির জন্য। চাকরি তাে পাইনি বরং বিনিময়ে যা পেয়েছি তাতে আমার জীবনে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে ব্যর্থতার রূপ।

ব্যর্থতা

ব্যর্থতা যখন মানুষকে ঘিরে ধরে তখন সােনাও লােহা হয়ে যায়। ভাগ্য ছাড়া আর কাউকে আমি দোষ দেব না। আর দিয়েই-বা লাভ কী? আমার বেকারত্বের জন্য আমার মা-কে হারাতে হয়েছে, বােনকে পাত্রস্থ করতে পারিনি।

বাবার আমাকে নিয়ে এত স্বপ্নের কোনাে মূল্যই দিতে পারিনি। বিদ্যালয়ে শিক্ষক মহাশয়ের কাছে শুনেছি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানাে পাপ, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা উচিত প্রভৃতি।

কিন্তু সে সব কথা আমার কাছে হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। কঠোর বাস্তবের রূঢ় আঘাতে সমস্ত দর্শন কীভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায় তা আমি উপলব্ধি করেছি।

পরিণাম

একবার মনে হয়েছিল, অসামাজিক কোনাে কাজ করে অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করি। কিন্তু মনে হল বাবার কথা- যিনি কখনাে তা সমর্থন করতেন না।

তাই মাকে হারিয়েছি, বাবাকে হারাতে চাইনি বলেই তার আদর্শের বিরােধী হতে পারিনি। যেমন করে হোক সামান্য অর্থ উপার্জন করে দুবেলা অন্নের সংস্থানের উপায় সন্ধান করেছি।

প্রতিকার

আমার এই বেকারত্বের যন্ত্রণা আমাকে বাস্তবের মুখােমুখি করেছে। আমার পড়াশােনার জন্য এত টাকা খরচ না করে বাবা যদি প্রথম থেকে আমাকে আরাে অর্থকরী উপায়ের সঙ্গে যুক্ত করতেন তাহলে ভালাে হত।

বেকারত্বের যন্ত্রণা যে বেকারের জীবনকে মরুভূমির মতাে করে দেবে, তা আমাদের অভিভাবকদের জানা উচিত ছিল। সেভাবে আমাদেরকে প্রথম থেকেই অর্থকরী উপায়ের সঙ্গে যুক্ত করে দিলে অনেকটা উপকার হত।

পরিশেষ

এখন তাে আমার সত্যজিৎ রায়-এর ‘হীরক রাজার দেশ’-এর কথা মনে পড়ে।

কেননা কথাগুলি ছিল অপ্রিয় সত্য। যে পয়সা আমার শিক্ষার জন্য ব্যয়িত হয়েছে, সেগুলি থাকলেও আমার সংসারে এত দুরবস্থা হত না বলে আমার মনে হয়। আমার এই বেকারত্ব যেন আরাে পাঁচটা বেকার সৃষ্টি না করে তার জন্য এসব কথার অবতারণা।