আমাদের বিদ্যালয়ের রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব

সূচনা

প্রতি বছরের পঁচিশে বৈশাখ তারিখটি আমাদের কাছে বড় আনন্দের। কবে এই দিনটি আসবে আমরা তারই প্রতীক্ষায় দিন গুণতে থাকি।

পঁচিশে বৈশাখি আমাদের কাছে ‘বারাে মাসে তেরাে পার্বণের’ যেন একটি পার্বণ। আমাদের প্রিয় কবি-বিশ্ব- কবি রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে আমরা কতই-না স্বপ্ন রচনা করি।

বিশেষ করে এই বছরটা আমাদের কাছে বিশেষ আনন্দের ছিল।

কারণ, এবছর আমাদের বিদ্যালয়ে ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব’ বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়েছিল।

আমি যখন নীচের ক্লাসে পড়ি, তখন থেকেই দেখে আসছি, প্রতি বছর ২৫শে বৈশাখ তারিখটিতে আমাদের স্কুলে রবীন্দ্র-জন্মতিথি উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

কিন্তু এবারের উৎসবের কথাটি আমি ভুলতে পারব না, কারণ, এবারকার উৎসব-কমিটির আমিই ছিলাম সম্পাদক।

উৎসবের দায়-দায়িত্ব অনেকখানিই আমাকে বইতে হয়েছে।

উৎসব-সাফল্যের কৃতিত্ব আমি নিতে চাইছি না, কিন্তু উৎসবের আয়ােজনে যেভাবে আমি একাত্ম হয়ে পড়েছিলাম তার আনন্দ সত্যি অবিস্মরণীয়।

হ্যা, এখন আর আমি নীচের ক্লাসের ছাত্র নই, এখন আমি একাদশ শ্রেণীর ছাত্র এবং হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার পরীক্ষার্থী। ভূমিকা অযথা দীর্ঘ না করে উৎসবের বিবরণটিই এবার লিখতে চেষ্টা করব।

উৎসবের গুরুত্ব রক্ষার প্রয়াস

রবীন্দ্র-জন্মতিথির উৎসব আজ আমাদের জাতীয় উৎসবেই পরিণত হয়েছে, সুতরাং উৎসবের গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য যাতে রক্ষিত হয়, গােড়া থেকেই আমরা সর্বপ্রযত্নে তার প্রয়াসী ছিলাম।

উৎসব যাতে উৎসব হয়ে উঠে, গতানুগতিক প্রাণহীনতায় পর্যবসিত না হয়, সে বিষয়ে উৎসব-কমিটির উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় বাংলা-শিক্ষক মহাশয় আমাদের সব সময়ে সচেতন রেখেছিলেন।

অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, উৎসবে সাজসজ্জা থাকবে আনন্দ-অনুষ্ঠান থাকবে না।

ওগুলাে উৎসবের অঙ্গ, ওগুলােকে বাদ দিলে উৎসবের অঙ্গহানি ঘটে। কিন্তু ঐসব বাইরের অনুষ্ঠানে যাতে পরিমিতিবােধ বজায় থাকে, সেইটেই হল আসল কথা।

অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্ব

মাসখানেক আগে থেকে আমরা উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। প্রতি শ্রেণীতে যারা আবৃত্তি, গান, প্রবন্ধ রচনায় আগ্রহী তাদের মাঝে যেন অনেকটা সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল।

এবার বাইরে থেকেএকজন বিশিষ্ট বাংলার অধ্যাপককে সভাপতির আসন অলংকৃত করবার জন্যে বিনীত আহ্বান জানানাে হয়েছিল, সে-ডাকে তিনি সাড়াও দিয়েছিলেন।

প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সহযােগিতায় চারজন শিক্ষক মহাশয় আমাদের সত্যই আন্তরিক ভাবে সাহায্য করেছিলেন।

বিভিন্ন শ্রেণীর উপযােগী কবিগুরুর ৫/৭টি কবিতা শিক্ষক মহাশয়গণ ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমরা অনেকেই এতে অংশগ্রহণ করেছিলাম।

পরে ‘হিট’ করে যারটা ভাল বলে বিবেচিত হল, সে-ই উৎসবের দিন আবৃত্তি করবে বলে স্থির হ’ল। কোন কবিতা কিভাবে আবৃত্তি করতে হবে তার নির্দেশও মাষ্টার মশায়গণ আমাদের দিয়েছিলেন।

আমাদের বাঙলার শিক্ষক মশায় ভারী সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারেন- তিনি আমাদের গানের ‘ট্রেনিং দিয়েছিলেন।

যারা প্রবন্ধ রচনা করতে পারে, তাদের প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল।

পরে মাষ্টার মশায়গণ তা সংশোধন করে দিয়েছিলেন। এবারে আমাদের বিদ্যালয়ে কবিগুরুর জন্মদিনে একটি নতুন জিনিসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল- তা হ’ল বক্তৃতা প্রতিযােগিতা।

বিশেষ একটি বিষয় নিয়ে ছাত্ররা যে যার যােগ্যতা অনুযায়ী বক্তৃতা করবে।

যাদের ভাল হবে তাদের তিনজনকে পুরস্কার দেওয়া হবে।

এই অনুষ্ঠানটি সত্যই বেশ আনন্দের হয়েছিল। তবে এবছরের সবচেয়ে আনন্দের অনুষ্ঠান ছিল নাটক। আমরা কবিগুরুর ‘বিসর্জন’ নাটক অভিনয় করেছিলাম।

এই অভিনয় এত সুন্দর হয়েছিল যে তা প্রত্যেকের কাছেই প্রশংসা পেয়েছিল। আর একটি চিত্তাকক অনুষ্ঠান ছিল ‘ছায়ানাট্য। কবিগুরুর ‘পুরাতন ভৃত্য এবং ‘দেবতার গ্রাস’–এই দুইটি কবিতা আমরা ছায়ানাট্যের মাধ্যমে অভিনয় করেছিলাম।

উৎসবের দিনে প্রয়ােজনীয় সাজসজ্জা

২৪শে বৈশাখ থেকেই আমরা বিদ্যাভবনটিকে পুষ্পে-পল্লবে সুন্দর করে সাজাতে শুরু করেছিলাম।

যে-সুবৃহৎ হ-ঘরটিতে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটিও সজ্জিত করা হয়েছিল রুচিসম্মত ভাবে। ২৫শে তারিখে সকাল ১০টার মধ্যেই আমরা সাজসজ্জাদি শেষ করে ফেলেছিলাম।

হল-ঘরের অনতি-উচ্চ ক্ষুদ্র মঞ্চের দু’পাশে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টি সুবৃহৎ চিত্র, দু’টিই একেছিল।

আমাদের স্কুলের উদীয়মান চিত্রশিল্পী কাজল কর। ছৰি দু’টিকে সাজিয়েছিলাম শ্বেত রজনীগন্ধার গুচ্ছ দিয়ে, আর তার পাশে ছিল সুরভি ধূপধার।

রজনীগন্ধা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয় ফুল, তাই রজনীগন্ধা ছাড়া উৎসব-সভায় আমরা অন্য কোনাে ফুল ব্যবহার করিনি।

হল-ঘরের দেওয়ালেও ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম মােটা-করে-গাঁথা রজনীগন্ধার বৃত্তাকার মালা।

উৎসব-ক্ষণে ফুলের গন্ধে, ধূপের ধোঁয়ায়, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের নীরব শ্রদ্ধায় উৎসব-কক্ষের পরিবেশটি সত্যি মনােরম হয়ে উঠেছিল।

উৎসবের বর্ণনা: আবৃত্তি, সংগীত, সভাপতির অভিভাষণ প্রভৃতি

দেখতে দেখতে ২৫শে বৈশাখ এগিয়ে এল মনে আনন্দ আর ধরে না। উৎসব শুরু হল বিকেল পাঁচটায়।উৎসব যাতে সর্বাঙ্গ-সুন্দর হয়, তার জন্যে শিক্ষক এবং ছাত্রদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না।

এই সময় লক্ষ্য করেছি যে সমস্ত মাষ্টার মশায় ক্লাসে আমাদের কাছে ভীতির কারণ, তারাই এই সময় আমাদের আনন্দ দিয়েছেন বেশি। ষ্টেজ তৈরী শুরু হল।

উপরের ক্লাসের ছাত্রেরা এই ব্যাপারে পরিশ্রম করলেন বেশী তাদের সঙ্গে সহযােগীতা করলেন মাষ্টার মশাইরা।

কয়েকটি ‘গেট’ও তৈরী করলাম। প্রত্যেক ছাত্রের অভিভাবককে, নিকটবর্তী স্কুলকে এবং স্কুলের পাশাপাশি বিশিষ্ট ভদ্রলােকদের নিমন্ত্রণ করা হল।

এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন “বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশিষ্ট বাংলার অধ্যাপক।

‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’- কবিগুরুর এই গানটি দিয়েই সভার উদ্বোধন হল।

তারপর কিছুক্ষণ ধরে চলল আবৃত্তি আর গান। আমাদের ক্লাসের সৌমিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঐকতান’ কবিতাটি এমন সুন্দর আবৃত্তি করলে যে, সমবেত সকলেই মুগ্ধ হলেন।

ছাত্রদের নাচ, গান, আবৃত্তি, বক্তৃতা, অভিনয়ের পর হল সভাপতির ভাষণ।

সভাপতি মশায় অতি চমৎকার ভাষায় কবিগুরুর শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সে বক্তৃতা আমাদের মনে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

সভাপতি মহাশয় যথাসময়েই এসে আসন গ্রহণ করলেন, আমন্ত্রিত অতিথিরাও এলেন, শ্রদ্ধেয় প্রধান-শিক্ষক এবং অন্যান্য শিক্ষকও যথাযােগ্য আসনে উপবেশন করলেন।

রবীন্দ্রনাথের লেখা কয়েকটি দেশাত্মবােধক গান গাওয়া হল, কয়েকটি ঋতু-সংগীতও।

আমি এবং আর-একটি ছাত্র দু’টি প্রবন্ধ পড়লাম।তারপর প্রধান শিক্ষকমহাশয় এবং অন্যান্য কয়েকজন মাষ্টার মশায় মনােরম ভাষণ দিলেন । সবার শেষে সভাপতি উঠলেন ভাষণ দিতে।

গতানুগতিক প্রথায় বহুবার-শুনা কথার চর্বিত চর্বণ করলেন তিনি। জীবন ও জীবনের চিন্তাধারা-যে পরিবর্তনশীল, রবীন্দ্রকাব্যের আলােচনা করে তিনি তারই একটি সুন্দর ব্যাখ্যা শােনালেন।

রবীন্দ্রনাথ তার সুদীর্ঘকালব্যাপী সাহিত্যসাধনায় কোথাও এক জায়গায় থেমে থাকেন নি, তিনি ছিলেন বিচিত্রের পূজারী। সােনার তরী-‘চিত্রা’র রবীন্দ্রনাথ, ক্ষণিকা’র রবীন্দ্রনাথ, খেয়া’র ও ‘বলাকা’র রবীন্দ্রনাথে বিস্তর প্রভেদ।

আবার ‘পরিশেষ’-‘পুনশ্চ’ থেকে ‘জন্মদিনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরূপ সম্পূর্ণ পৃথক।

জীবনভাের রূপ থেকে রূপান্তরে আবর্তিত হয়েছেন কবি, তার পিছনে সমাজ-ব্যবস্থার পরিবর্তনও কাজ করেছে। এইসব কথাই মনােজ্ঞ ভাষায় প্রকাশ করলেন সভাপতি।

শেষের দিকে ব্যাখ্যা করলেন ছাত্রদের নিকট রবীন্দ্র-জন্মতিথি উৎসবের তাৎপর্য।

তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্রতী। প্রকৃতি ও বাইরের সঙ্গে সংযােগহীন বিজাতীয় শিক্ষার পেষণে-যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ্যা হয়ে আছে, একথাই রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন বহু রচনার মাধ্যমে ও বক্তৃতায়।

প্রসঙ্গতঃ কবিগুরুর লেখা ‘তােতা-কাহিনী’র উল্লেখ করলেন।

বললেন, দেশের তােতাদের যদি আমরা বাঁচাতে পারি অপমৃত্যুর হাত থেকে, তবেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের সত্যিকার শ্রদ্ধা দেখানাে হবে, সার্থক হয়ে উঠবে তার জন্মতিথি-উৎসব পালন।

তার ভাষণ আমার খুবই ভালাে লাগল, সমবেত শ্রোতাদেরও তা অভিভূত করলে।

অভিনয়

উৎসবের শেষে আমরা অর্থাৎ স্কুলের ছেলের। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’র নাট্যরূপের অভিনয় করলাম। আমি নিজে ‘উপেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম।

অভিনয় খুবই হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল, অন্তত দর্শকগণের তা-ই অভিমত।

উপসংহার

অভিনয় শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবও শেষ হল। এইভাবে উৎসবের সমস্ত অনুষ্ঠান যখন শেষ হ’ল- তখন রাত প্রায় তিনটা।

ধীরে ধীরে দর্শকেরা সবাই চলে গেলেন, আলাে নিভে গেল সভাগৃহের, আমরাও পা বাড়ালাম যে-যার বাড়ির দিকে। এতদিন ধরে যে দিনকে কেন্দ্র করে আমাদের মনে আনন্দের সীমা ছিল না।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তার পরই সমাপ্তি। মনটা ব্যথায় ভরে গেল আমাদের।

কিন্তু তখনাে আমার মনকে আবিষ্ট করে জেগে রইল উৎসবের রেশ ধূপের সুরভি আর রজনীগন্ধার গন্ধের মতো।

তবে এই কথা ভেবে আনন্দ পেলাম যে আবার আগামী বছর আমরা আমাদের প্রিয় কবির জন্মদিন পালন করব।