ভূমিকা
বাংলার প্রকৃতিতে ঋতুচক্রের আবর্তনে হেমন্তকালের পরই শিশির ঝরিয়ে শীতের আগমন।
শীতকালের একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, বিশেষ করে শীতের সকালে প্রকৃতির স্নিগ্ধ শীতল রূপমাধুরী যে কোনাে সৌন্দর্য অনুরাগী মানুষের মনকে আনন্দে ভরিয়ে তােলে।
শীতকাল কী
পৌষ ও মাঘ মাসকেই আমরা শীত বলিয়া জানি। কিন্তু বাঙলা দেশে কার্তিকের শেষভাগ হইতেই কিছুটা শীত অনুভূত হতে থাকে। হেমন্তের শেষার্ধে উহা তীব্র হয়ে উঠে এবং পৌষ-মাঘে তীব্রতম হয়।
এই প্রাখর্যের জন্যই পৌষ-মাঘ শীত ঋতু নামে পরিচিত।
- বইমেলায় একটি সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা রচনা লেখ
- একটি নির্জন দুপুরের স্মৃতি নিয়ে প্রবন্ধ লেখ
- শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি রচনা
- নদীর তীরে বনভোজন করার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা
শীতকালে সকালের অবস্থা
শীতের সকাল কারাে কাছে আনন্দের, আবার তা কারাের কাছে বিষাদের। আমার কাছে শীতের সকাল মনােরম নয়। শীতের জড়তায় আমি ভীত হয়ে পড়ি।
তাই সকাল হয়ে গেলেও, পাখি ডেকে ডেকে সারা হলেও আমি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ভালােবাসি।
কিন্তু মায়ের ডাকাডাকিতে তা আর হয়ে ওঠে না।তাই বাধ্য হয়ে উঠে পড়েই একটু রােদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি।
শীতের অবস্থা
শীতের সকালে উত্তর দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে থাকে। ঠাণ্ডায় হাত-পা যেন কুয়াশা দেখা দেয়, বৃষ্টির মতাে টুপটুপ করে শিশির পড়তে থাকে। পথ-ঘাট শিশির স্নাত হয়।
একটি ধানের শিষের উপর শিশির বিন্দু ঝন্ম করতে থাকে। পাখির কলকাকলিতে পরিবেশ সুন্দর হয়ে ওঠে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে। তখন লেপ কাঁথা ছেড়ে বয়স্করা রােদের কাছে এসে রােদ পােহায়।
আবার যারা গরিব, যাদের পরনে শীতের পােশাক থাকে না তারা হাঁটু বুকে চেপে ধরে রােদ পােহাতে থাকে।
অনুভূতি
শীতের সকালের সবচেয়ে প্রিয় হল খেজুর রস। খেজুর রস নিয়ে ভার করে ঘুরতে শিউলিরা।
এই শিউলিরাই আগের দিন গাছ কেটে কলসি গাছে ঝুলিয়ে রাখে এবং সকালে তা নামিয়ে এনে আমাদের উপহার দেয়। কনে ঠাণ্ডায় সেই কঙ্কনে খেজুর রস খাওয়া যে কি উপাদেয়, তা বলে বােঝান যায় না।
সেই সঙ্গে দূর থেকে কানে ভেসে আসে ফেরিওয়ালার মােয়া আর নলেন গুড়ের পাটালি ফেরির সুমধুর কণ্ঠস্বর।
শীতের সকালে মাঠের ধান গাছে শিশির পড়ে সুন্দর এক পাকা সােনার রঙ সৃষ্টি করে। তাতে প্রজাপতি যখন ঘুরে বেড়ায়, তখন এক মােহময় সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কৃষকেরা সেই সকালে মনের আনন্দে মাঠে গিয়ে ধান কাটে।
যে সব কৃষকেরা ফসল ফলায় তারা মনের আনন্দে সবজি তুলে বিক্রয়ের জন্য আঁকা ভর্তি করতে থাকে। রাস্তার কুকুরগুলাে সারা রাতের শীত হজম করে রােদে গা এলিয়ে দিয়ে সুখ অনুভব করতে থাকে।
শহরের শীতের সকাল
শহরের শীতের সকাল একটু অন্যরকম। শহরে গাড়ির ঘর্ঘর শব্দে ঘুম ভাঙে। রােদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের জানালা দরজা খােলা হয়। তার আগে কর্পোরেশনের ঝাড়ুদাররা রাস্তা ঝাঁট দিয়ে যায়।
রাস্তার মােড়ে মােড়ে দেখা যায় গত রাতের আগুন জ্বালিয়ে শীত কাটানাের ধ্বংসাবশেষ। গাড়ি চললেও রাস্তাগুলি ব্যস্ত থাকে না, বরং তা বেশ ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়।
বাজারে টাটকা সবজি নিয়ে দোকানদাররা তাদের পশরা সাজায়। চায়ের দোকানে ভীড় বাড়ে। কুয়াশা ও শীতের জড়তা দূর করে ট্রাম ঘর্ঘর শব্দে এগিয়ে চলে।
পট পরিবর্তন
সকালের প্রাথমিক জড়তা কেটে যায়। ক্রমে বেলা বাড়ে। গৃহিণীরা কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কেননা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিবারের ভরণীয়বর্গের মুখে তুলে দিতে হবে আহার।
ওদিকে কুয়াশামুক্ত সূর্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গােপালকরা মাঠে গােরু চরাবার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। কৃষকরা ফসল ঘরে আনবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
কামারশালে ‘ঠকা ঠাই ঠাই’ শব্দ এবং তাঁতীদের কাপড় বােনার জন্য মাকুর ঘটঘট শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
স্কুলের ছেলেরা শীতের পােশাক গায়ে দিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে, বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন কাজের মানুষেরা তাদের যে যার কাজের জন্য।
খাদ্যসুখ: ফসল তােলার সময়
শীত-ঋতু নানাভাবে বাঙালীর পক্ষে উপকারী।
অন্য ঋতুর তুলনায় এই ঋতুতে মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, কঠোর শ্রমসাধ্য কাজেও অবসাদ আসে না। বাঙলার পল্লীতে পল্লীতে কৃষকগণ ধান কেটে সেগুলি ঘরে তুলিবার কাজে ব্যস্ত থাকেন।
গ্রাম-বাঙলার ঘরে ঘরে তখন আনন্দের সাড়া পড়ে যায়।
নূতন গুড়ের মিষ্টি গন্ধে তখন গ্রামীণ প্রতিবেশ সুরভিত হইয়া উঠে। এই তাতারসি ‘বিধাতার এই সৃষ্টি মাঝে বাঙালীর সৃষ্টি’ কবির কথায়-
রসের ভিয়া বার করেছি আমরা বাঙালী,
রস তাতিয়ে তাতারসি, নলেন পাটালি।
খাদ্যসুখের জন্যও শীতকাল বাঙালীর প্রিয়। কমলালেবু, কপি, কড়াইশুটি, আলু, মূলা, বেগুন প্রভৃতির প্রাচুর্য এই সময়েই থাকে।
শীতের সকালের মজা
শীতের সকাল যদি ছুটির দিন হয় এবং ঐ দিন যদি বনভােজনের আয়ােজন থাকে তাহলে তাে কথাই নেই।
কারণ শীতের সকালে পড়ার জন্য উঠতে দেরি হয় কিন্তু যদি ঐ সকালে বনভােজনের জন্য বেরিয়ে পড়ার কথা থাকে, তাহলে ভােরে উঠতে কোনাে অসুবিধা হয় না।
কারণ শীতে বনভােজনের জন্য কোনাে অরণ্যের প্রান্তে, কিম্বা নদীর তীরে গিয়ে আনন্দ করতে কার না ভালাে লাগে।
শীতের পার্বণ
শীতের পার্বণ-উৎসবের কথা বলিতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে নবান্নের কথা।পৌষ-সংক্রান্তির পিঠাপুলিও বাঙালীর বিশেষত্বের স্বাক্ষরবাহী। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র পূজা-উৎসব সরস্বতী পূজার কালই শীতের মাঘী শুক্লা পঞ্চমী।
খ্রীস্টানগণের শ্রেষ্ঠ পর্ব ‘বড়দিন’ উৎসব এই সময়েই পালিত হয় ; বঙ্গবাসী খ্রীস্টানগণ সেই পৰ্ব পালন করেন।
উপসংহার
শীতের সকাল যেমন জড়তার তেমনি তা মাধুর্যের। কেননা জড়তা কাটিয়ে যে মাধুর্যকে উপভােগ করা যায় সেই মাধুর্যই তাে চিরন্তন। এই শীতের মধ্যেই তাে মাঠের ফসল ঘরে আসে। কৃষকদের বড়াে উৎসব নবান্ন এই শীতেই অনুষ্ঠিত হয়। তাই শীতের সকাল যেমন জড়তার তেমনি আবার তা পূর্ণতার। তবে সেই পূর্ণতা সকলের জীবনে আসে না। কারণ আমাদের দেশে বহু মানুষ আছে যাদের পরনে এখনাে পর্যাপ্ত শীতের পােশাক জোটে না। তারা একটু রােদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আমাদের সহানুভূতি যদি সেইসব নিরন্ন, পােশাকহীন মানুষের মনে হাসি ফোটাতে পারে, তাহলে শীতের সকাল সকলের কাছে বয়ে আনবে পূর্ণতার বার্তা।