বিশেষণের তর ও তম বলতে কি বুঝ

‘বিশেষণের তর তম’ বুঝতে হলে,বিশেষণ পদটি যে কী, কেমন করে তাকে বিশেষ চেনা যায়, সেটুকু অবশ্যই প্রথমে বুঝে নেওয়া জরুরি।

সেই জন্য বিশেষণের সংজ্ঞাটি একবার জেনে নিতে হচ্ছে। বাক্যের যে পদ অন্য পদকে বিশেষিত করে,

অর্থাৎ যে পদের দ্বারা অন্য কোনাে পদের গুণ, অবস্থা, ধর্ম, সংখ্যা ইত্যাদি প্রকাশ পায়, সেই পদকে আমরা বলি বিশেষণ

যেমন : ভালাে ছেলে। লাল ফুল। পড়ন্ত বেলা। সােনার হরিণ। খাটোকাপড়। ভাঙা আয়না। কবেকার কথা। হাসি হাসি মুখ। ঝাঁঝাঁ দুপুর ইত্যাদি।

মােটা অক্ষরে চিহ্নিত পদগুলাের সবই হল বিশেষণ। এখানে বিশেষণের পরে যে পদগুলাে রয়েছে তারা হল বিশেষ্য পদ।

পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিশেষণ পদ কেবল বিশেষ্য পদকেই বিশেষিত করে, বিশেষিত করে সর্বনাম, ক্রিয়া এবং অব্যয়কেও। প্রয়ােজনে আবার নিজেকেও সে বিশেষিত করতে ছাড়ে। বিশেষণের ব্যবহারিক ক্ষেত্র খুবই বিস্তৃত।

কখনাে সে কোনাে কোনাে বিষয়কে নির্দিষ্ট করে, আবার কখনাে বিষয়কে অনির্দিষ্ট করে দেওয়াও তার স্বভাব। কখনাে সে পরিমাণ বােঝায়, কখনাে উপাদান, অবস্থা, গুণ এবং পরিচয়কেও তুলে ধরে।কখনাে বিশেষণ দেখা দেয় দ্বি-পদময় হয়ে, বহু পদময় বাক্য হয়ে, কখনাে কখনাে সে আবার সংখ্যাবাচকও হয়ে ওঠে। আমরা বিশেষণের বিশেষ একটি দিক নিয়ে এখানে আলােচনা করব।

আলােচ্য বিষয়টি হল, বিশেষণের তর তম। আমরা দেখেছি, একের চেয়ে অপরের বা বহুর মধ্যে একের গুণ-ক্রিয়াদির উৎকর্ষ বা অপকর্ষ প্রকাশ করার ব্যাপারে বিশেষণের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই প্রকাশ করাকেই বলা হয় বিশেষণের তর তম বা অতিশায়ন।

সংজ্ঞা হিসেবে বিষয়টিকে এইভাবে লেখা যেতে পারে : দুই বা দুইয়ের বেশি ব্যক্তি বা পদার্থের মধ্যে একটির সঙ্গে অপরটির তুলনা করে উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বােঝাবার জন্য তরতম’ প্রত্যয়যােগে বিশেষণের রূপে যে পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তিত ভিন্নতার নামই হল বিশেষণের তর তম বা অতিশায়ন।

যেমন : জন্ম ও জন্মভূমি স্বর্গের থেকে গরীয়সী।সংখ্যা গরিষ্ঠের ভােটে যদুবাবুরা পঞ্চায়েত দখল করলেন। রূপাের চেয়ে সােনা দামি। পশুদের মধ্যে হাতি বৃহত্তম। এখানে গরীয়সী, গরিষ্ঠ ও বৃহত্তম দেখা দিয়েছে উৎকর্ষ বােঝানাের জন্য, ‘গুরু’ ও ‘বৃহৎ’ বিশেষণের পরিবর্তিত রূপে, অতিশায়িত হয়ে।

বিশেষণের তর তম বােঝাবার জন্য। পক্ষান্তরে, রূপপার চেয়ে সােনার দাম যে বেশি, তা বােঝানাের জন্য ‘চেয়ে’ নামক পদান্বয়ী অব্যয় অনুসর্গটিকে ব্যবহার করা হয়েছে‘দামি’ বিশেষণটিকে অতিশায়িত করার জন্য। বলা বাহুল্য, বিশেষণের তর তম বােঝাবার এটিও একটি উপায়।

বিশেষণের তর তম বােঝানাের জন্য যে যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে, এখানে আমরা সেগুলােকে একে একে পরিচিত করতে চেষ্টা করব। এ পদ্ধতি দু’রকমের। একটি হল, সংস্কৃত পদ্ধতি, অপরটি আমাদের নিজস্ব, বাংলা পদ্ধতি।

বাংলা রীতিতে বিশেষণের তর ও তম

বিশেষণের তর তম বােঝাতে বাংলা ভাষায় আমরা যেমন সংস্কৃত রীতি ব্যবহার করি, অনুরূপভাবে আমরা আমাদের নিজস্ব বাংলা রীতিও অনুসরণ করি। বাংলা রীতিতে বিশেষণ পদটি অটুট থাকে। তার কোনাে পরিবর্তন হয় না।
তুলনাবাচক বিভিন্ন অনুসর্গ ব্যবহার করে ব্যাখ্যামূলক উপায়ে আমরা তুলনার বিষয়টি প্রকাশ করি। যাই হােক, এরই ভিতর গুটিকয়েক নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। সেই অনুসৃত পদ্ধতিগুলােকে এইভাবে একটি একটি করে দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে :

 

(১) দুই ব্যক্তির বা পদার্থের তুলনা করবার সময় আমরা যার সঙ্গে তুলনা করি, তার উল্লেখের পরেই থেকে, চেয়ে, চাইতে, অপেক্ষা, মধ্যে, হইতে, হতে ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহার করি।
এই অনুসর্গ দিয়েই পারস্পরিক উৎকর্ষের সম্পর্ক বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। যেমন :
  • অপেক্ষা : যদু অপেক্ষা মধু বুদ্ধিমান। রাম অপেক্ষা শ্যাম বয়সে বড়াে।
  • চেয়ে : ঢাকার চেয়ে কলকাতা বড়াে শহর। নাই- মামার চেয়ে কানা-মামা ভালাে।
  • চাইতে : জলের চাইতে সােনা ভারী। রুটির চাইতে ভাত আমার পছন্দ।
  • হইতে : ধন হইতে বিদ্যা বড়াে। ভারত হইতে ইংল্যান্ড ক্ষুদ্র দেশ।
  • হতে : বুদ্ধি হতে হৃদয় বড়াে। তামা হতে সােনা দামি।
  • থেকে : আমার থেকে মামা বয়সে বড়াে। গরমের থেকে লােকে শীতটাই পছন্দ করে।

 

(২) দুই ব্যক্তি বা পদার্থের মধ্যে অপকর্ষ বা উৎকর্ষের মাত্রা বােঝানাের জন্য আমরা বিশেষণ পদের আগে অধিক, অনেক, কম, বেশি, খুব, ঢের, একটু, একটুখানি, অনেকটা, আরও প্রভৃতি পরিমাণবাচক বা মাত্রাবাচক বা সংখ্যাবাচক বিশেষণ পদ ব্যবহার করি। যেমন : 
  • অধিক : রুপাের থেকে সােনা অধিক দামি।
  • অনেক : হরিণের চেয়ে হাতি অনেক বড়াে।
  • কম : সােনার থেকে তামা কম দামি।
  • বেশি : ক্ষিতীশের চেয়ে নরেন বেশি বুদ্ধিমান।
  • খুব : কলকাতার চেয়ে চুচুড়ায় জমির দাম খুব কম।
  • ঢের :চুচুড়ার চেয়ে গ্রামের জমির দাম ঢের কম।
  • আরও : সােনার থেকে হিরে আরও উজ্জ্বল।
  • একটু কম : রেশমি শাড়িটা সুতাের শাড়ির চেয়ে একটু কম দামি।
  • একটু বেশি : আমার কলমটা তােমার কলমের চেয়ে একটু বেশি মােটা।
  • অনেকটা : সে আমার চেয়ে অনেকটা বেশি লম্বা।

(৩) বাংলা ভাষায় বিশেষণের তর তম বােঝানাের জন্য আমরা ব্যাখ্যানমূলক উপায়েও ব্যক্তি বা পদার্থের তুলনা করি। এখানে মধ্যে অনুসর্গটিকে বেশি ব্যবহার হতে দেখি। যেমন :

  1. কুকুর ও বেড়াল, এই দুইয়ের মধ্যে কুকুর বড়াে।
  2. পরেশ ও নরেন, দু’জনের ভিতর নরেনই পরিশ্রমী।

(৪) বহুর মধ্যে তুলনা করে একটির উৎকর্ষ বা অপকর্ষ জানাতে গেলে আমরা সাধারণত সর্বাপেক্ষা, সবচেয়ে, সব থেকে, সকলের চেয়ে, সকলের মধ্যে ইত্যাদি পদ বা পদাংশ ব্যবহার করি। যেমন :

  1. এই ছবিটি সবচেয়ে (সব চেয়ে) ভালাে।
  2. ছেলেটি গ্রামের মধ্যে সব চাইতে বদমাশ।
  3. রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে সব চেয়ে বড়াে কবি।
  4. সব হতে আপন, আমাদের শান্তিনিকেতন।
  5. হিমালয় সর্বাপেক্ষা বড়াে পাহাড়।
  6. এভারেস্ট পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
  7. সাধুতাই সর্বোত্তম গুণ।