ভূমিকা : দার্জিলিং ভ্রমণ
বড় সাধ ছিল হিমালয় দেখব। ভারতের মানচিত্র দেখে সেই-যে হিমালয়কে দেখলাম – কালাে রেখাশ্রেণী – তার পর যতই দিন গেছে, ততই সে দেবভূমি তপােভূমি হিমালয়কে দেখবার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে চলেছিল।
ছোটবেলার সেই প্রথম আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল দার্জিলিং ভ্রমণ করে। এমনই এক বৈশাখ মাসে একটি অপ্রত্যাশিত সুযােগ পেয়ে প্রথম দার্জিলিং যেতে পেরেছিলাম।
পথের বর্ণনা কিছু দেব না, সে নিস্তব্ধ গিরিরাজকে দেখলে ‘দার্জিলিং- হিমালয়ান রেলপথের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যও অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়।
পথে শিলিগুড়ি স্টেশনে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথ
তথন বৈশাখের শেষ। পথে গাড়িতে অসহ্য গরম বােধ হচ্ছিল, সারা- রাত্রি একটুও ঘুমাতে পারলাম না। শিলিগুড়ি এসে নামতেই কিন্তু কেমন শীত বােধ হতে লাগল।
অনেকেই কিছু গরম পােশাক পরে নিলেন। প্রভাতে বিশ্রাম ও জলযােগ সেরে দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওএর গাড়িতে চড়লাম।
ছােট ছােট গাড়ি প্রায় কলকাতার ট্রামের মতাে, গতিও প্রায় একরূপ, কিছুদূর গিয়েই সম্মুখে ও পশ্চাতে দুটি ইঞ্জিন তাকে উপরে ঠেলতে লাগল।
বুঝলাম, সমতলভূমি হতে পর্বতারােহণ শুরু হয়েছে। গাড়ি নিজেকে যথাসম্ভব হালকা করে, যথাসম্ভব ধীর গতিতে দুটি ইঞ্জিনের সাহায্যে হাপিয়ে হাপিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
উপলপূর্ণ শুষ্ক মহানদী পার হয়ে আমরা প্রবেশ করলাম অনন্ত অরণ্যশ্রেণীর মধ্যে। এটাই হল হিমালয়ের তরাই। অতি দীর্ঘ অথচ তীরগতির ন্যায় সরল, বিশাল শালবৃক্ষ, আরও কত বৃক্ষ পাতায় পাতায়, মাথায় মাথায়, ঠেকাঠেকি করে রয়েছে।
অনন্ত বৃক্ষশ্রেণী নিয়ে এক-একটি অরণ্য, অনন্ত অরণ্যশ্রেণী নিয়ে এক-একটি পর্বত, এইরূপ যেন অনন্ত পর্বতশ্রেণী চলে গেছে। এখনও তার আরম্ভ দেখা যায়-ভারতের উত্তর সীমান্তে, কিন্তু শেষে তাও লুপ্ত হয়ে আসলো।
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথের বর্ণনা
কী কৌশলেই এঞ্জিনী আর পর্বতের উপর দিয়ে লৌহবত্ম নির্মাণ করয়েছেন। গাড়ি কোথাও ঠিক পর্বতের প্রান্ত বয়ে চলেছে ; নিম্নে দেখলে মনে হয়-সহস্র হস্ত নীচে এখনি পড়ে গিয়ে আরােহিসহ গাড়ি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে।
কোথাও পর্বতগাত্র ভেদ করে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে, কোথাও মহাসর্পের মতাে কুণ্ডলী পেকে, কোথাও নীড়ত্যাগী বিহঙ্গের মতাে ক্রমশঃ উর্বদিকে উঠে, কোথাও-বা একবার সম্মুখে আবার পশ্চাতে পুনঃপুনঃ উঠানামা করে, গাড়ি সমতলভূমি হই ৭,০০০ ফুট উর্ধ্বে উঠতে লাগল।
কার্শিয়াং-এ
কার্শিয়াং উঠে বেশ শীত বােধ হতে লাগল। দূরে চিরতুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গমালার প্রথম দর্শন লাভ করলাম। সে-যে কী আনন্দ, মনে করলে আজও অঙ্গে পুলক উঠে! অলক্ষ্যে কণ্ঠ হতে বের হল ভারতমাতার বন্দনাগীতি- “অম্বরচুম্বিত-ভাল হিমাচল, শুভ্রতুষারকিরীটিনি!”
ঘুম স্টেশনে
ভালো করে গরম পােশাক পরে উত্তরে ঐ পর্বতমালা এবং নিম্নে সূর্যকিরণে বিচিত্রিত মেঘপুঞ্জের শােভা দেখতে দেখতে উপরে উঠতে লাগলাম। সন্ধ্যার অল্প পূর্বে দার্জিলিংয়ের পূর্ববর্তী ‘ঘুম’ স্টেশনে পৌছলাম।
প্রথমে কোথায় এসেছি কিছুই বুঝতে পারলাম না। এই কি মেঘলােক? এই কি ইন্দ্রলােক? পুঞ্জ পুঞ্জ ধবল বাষ্পে বিশ্ব ঢেকে গেছে। বিশ হাত দূরে কিছুই দৃষ্টিগােচর হয় না, ইহার মধ্যেও সব অস্পষ্ট।
নিশ্বাসে নিশ্বাসে মেঘবাষ্প উদরস্থ হতে লাগল, জামা-কাপড়ের উপরে শিশিরকণার মতাে বাষ্পকণা জমতে লাগল। গাড়ির ভিতর-বাহিরে সর্বত্রই এই মেঘ। বুঝলাম, নৃতন লােকে এসেছি বটে।
দার্জিলিং স্টেশনে
এখান হতে আর মাত্র তিন মাইল দূরে দার্জিলিং শহর। সন্ধ্যার পরে বৈদ্যুতিক আলােকমালা জ্বলে উঠলেও শুভ্র মেঘস্তর ভেদ করে তার শােভা আমাদের চোখে বেশি পড়ল না।
স্টেশনে নামে দেখলাম, নেপালী ও ভুটিয়া মেয়ে-কুলীর ভিড়। বাইরে অতি বলিষ্ঠ ও দীর্ঘদেহ ভুটিয়া রিক্শাওয়ালা রিক্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক মণ বােঝা পর্যন্ত মেয়ে-কুলীরাও কপালে দড়ি লাগিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে চলল।
একজন সম্মুখে ও দুইজন পশ্চাতে রিক্শা টানে ও ঠেলে নিয়ে চলল। আমরা ‘লাস-ভিলা’য় উঠলাম।
সূর্যোদয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য
পরদিন প্রত্যুষে উঠেই উত্তর দিকের জানালায় গিয়ে দাড়ালাম। যা দেখলাম, তাতে চক্ষুকে বিশ্বাস হল না। মেঘমুক্ত নির্মল প্রভাতখানি ! সূর্য উঠে নাই বটে, কিন্তু চারিদিক পরিষ্কার।
ঐ কি হিমালয় পর্বত? ঐ কি কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চ শৃঙ্গ? এই কি মন্ত্রী ও পার্ষদ পরিবেষ্টিত রাজাধিরাজ আপন ধবল মহিমায় বিরাজমান?
অথবা বিভূতিভূষিত মহেশ্বর রজত-গিরিনিভ কান্তি নিয়ে অনুচরগণের সঙ্গে আবির্ভূত হইয়াছেন ? দেখতে দেখতে অরুণ কিরণ তুষার-কিরীটে পতিত হয়ে সােনার কান্তিতে জ্বলে উঠল।
প্রথমে সম্রাট কাঞ্চনজঙ্ঘার ও পরে পার্ষদগণের শৃঙ্গ হতে শৃঙ্গান্তরে সােনার বিদ্যুৎ ক্ষণেকের তরে জলিয়া জলিরা ছুটতে লাগিল, যেন মুহূর্তের মধ্যে সােনার ভাষায় প্রকৃতির সঙ্গে কী কথা হয়ে গেল?
মুহূর্ত পরেই সব শেষ। পাদদেশে সঞ্চিত ধবল মেম্বসমুদ্র সূর্যের দীপ্তিতে ঝকঝক করে উঠল। দেবদারু বনের মধ্যে শ্যামকান্তির অসীম বিস্তার! আমার ভাগ্যকে প্রশংসা করলাম।
দার্জিলিংয়ের অনন্য সৌন্দর্য
পরে হিমালয়ের অনেক শােভা দেখেছি। সিঞ্চল গিরিশ্রেণীতে শাদূল গিরির (Tiger Hill) শীর্ষে উঠে গৌরীশংকর ও কাঞ্চনজঙ্ঘা গিরিশ্রেণী দেখেছি।
সাংডাপ ফু-শিখরে উঠে পৃথিবীর অতুলনীয় দৃশ্য দেখেছি ; দেখেছি-একদিকে নেপাল-সীমান্ত, অপরদিকে সিকিম-সীমান্ত, সম্মুখে তিব্বত, পশ্চাতে ভারতবর্ষ, দূরে গৌরীশংকর, মকলু, ধবলগিরি।
আর এদিকে জুনাে, কাবরু, কাঞ্চনজঙ্ঘা ; অদূরে যােজনব্যাপী সুগন্ধি দেবদারু বন, আর রডােডেন্ড্রন ফুলের অনন্ত বর্ণবাহার ; তুষারপাত হওয়ায় পদতলে ধরণী শুভ্র হয়েছে।
মধ্যে নির্ঝরিনির কলঝংকারে স্তব্ধ অরণ্যানী ঝংকৃত হয়ে উঠেছে, জটাজ,টশােভিত মুনিগণের ন্যায় দীর্ঘ শৈবাল-সমাচ্ছাদিত বৃদ্ধ বৃক্ষের শাখায় বাংলা দেশের কোকিল ও বউ-কথা-কও ডাকছে।
দক্ষিণে দূরে- অতিদূরে সমভূমির বক্ষ চিরিয়া অনন্ত রজতরেখার ন্যায় গণ্ডকী, কুশী, মহানদী হিমালয় থেকে নামে ভারতকে পবিত্র করবার জন্য ছুটছে। কিন্তু দার্জিলিংয়ের প্রথম প্রভাত- খানি আমার মনে যে-ছবি এঁকেছে তার তুলনা নেই।
উপসংহার
দার্জিলিং শহরে ও সন্নিকটে বহু দ্রষ্টব্য স্থান আছে। দার্জিলিং বাজার, অবজারভেটরি হীল বা মহাকাল পর্বত, জলাপাহাড়, মিউজিঅম, বােটানিক্যাল গার্ডেন, লেবং, ঘুম গুম্ফা প্রভৃতি অনেক বর্ণনীয় স্থান আছে।
কিন্তু আজ পর্বতরাজ হিমালয়ের অপূর্ব মহিমা, গৌরব ও গাম্ভীর্য আমার সমস্ত অন্তঃকরণ অধিকার করে রয়েছে। ‘
আমার কেবলই মনে পড়ছে শ্রীভগবানের সেই উক্তি- “আমি পর্বতগণের মধ্যে হিমালয় ! পর্বত- গণের মধ্যে হিমালয়েই আমার মহিমা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রকটিত।”