ছাত্র জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে বাংলা রচনা

ভূমিকা

ভিত্তি দৃঢ় না হলে যেমন কোন বিরাট প্রাসাদ টিকে থাকেতে পারে না, তেমনি ছাত্রজীবনে যদি কিশাের বয়স্ক ছাত্রেরা যথাযথ ভাবে নিজেদের গড়ে না তুলে তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে তাহারা বড় হতে পারবে না।

কারণ ছাত্রজীবনই চরিত্র গঠনের উপযুক্ত কাল। যে কিশাের অবহেলা, আলস্য এবং উজ্জ্বলতার স্রোতে নিজের জীবনকে ভাসিয়ে দেয় সে কখনােই জীবনে উন্নতি করতে পারে না।

ভবিষ্যৎ জীবনে বড় হওয়ার চাবিকাঠি ছাত্র জীবনেই লুকিয়ে আছে।

জীবনের যে সময়টা আমরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া অতিবাহিত করি তা হলো আমাদের ছাত্রজীবন।

লক্ষ্য ও আদর্শ

আমাদের দেশের মনীষীগণ ছাত্রজীবনের লক্ষ্য ও আদর্শের ব্যাখ্যা করিতে গিয়ে বলেছিলেন, “ছাত্রানাং, অধ্যয়নং তপঃ”। লেখাপড়াই ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা।

কোন্ সুদূর অতীতে আমাদের দেশের দেবতাতুল্য মনীষীগণ ছাত্রজীবন সম্পর্কে যে উক্তি করিয়াছিলেন তাহা আজকের দিনে সত্য। জীবনকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে।

প্রতিটি বিভাগেই কর্তব্য ও দায়িত্ব স্থির আছে। যখন যা তখনই তাহা অনুসরণ না করলে  তাতে সফলতা লাভ করা যায় না।

ছাত্র জীবনের মূল আদর্শ শিক্ষালাভ; কিন্তু ছাত্রেরা যদি সেটি উপেক্ষা করিয়া আনন্দ উপভােগ এবং উজ্জ্বলতায় নিজেদের জীবন অতিবাহিত করে তাহলে বুঝতে হবে যে তারা তাদের কর্তব্যে অবহেলা প্রদর্শন করিতেছে।

যথা সময়ে যদি শিক্ষালাভ না করা যায় তাহলে ওই শ্রেষ্ঠ ধন হইতে তারা চিরকালের জন্য বঞ্চিত হবে।

ছাত্রদের অন্যতম আদর্শ গুরুজনের আদেশ পালন করা এবং শিক্ষকের অনুগত হওয়া।

মাতা, পিতা, শিক্ষক ও অপরাপর গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের আদেশ পালন করা ছাত্রদের একান্ত কর্তব্য।

যে ছাত্র গুরুজনদের প্রতি প্রকৃতই শ্রদ্ধাশীল তারা জীবনে অতি অবশ্যই উন্নতিলাভ করবে। বিশ্বে যাহারা মহাপুরুষ বলিয়া স্বীকৃত তাদের জীবনীই ছাত্রদের এই বিষয়ে শিক্ষাদান করবে।

তাই এই বয়সে ছাত্রদের কর্তব্য মহাপুরুষদের জীবনী পাঠ করা এবং তাঁদের জীবনের আদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে আগ্রহী হওয়া।

কারণ ছাত্রদের এই কথা মনে রাখতে হইবে, যে মহাপুরুষ হিসাবে যারা পৃথিবীতে খ্যাতিলাভ করিয়াছেন তাঁহারাও প্রত্যেকেই একদিন ছাত্র ছিলেন এবং তারাও ছাত্রদের মতই একদিন কিশাের ছিলেন।

ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলা ও গুরুত্ব

প্রতিটি কর্মানুশীলনের মধ্যে আছে একটি বিশেষ ধারাক্রম। এর নাম ছন্দ। সেই ছন্দই শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলাই হল শ্রী।

এই মানবজমিন দুর্লভ জমিন। এই মানবজমিনে সােনা ফলাতে হলে চাই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবােধের অনুশীলন। ছাত্রজীবন থেকে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন দরকার।

এখন তাদের মনের জমি কোমল।

এখন থেকেই সেই ভূমিতে শৃঙ্খলাবােধ ও নিয়মানুবর্তিতার বীজ বপন করতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে তাতে অমৃত ফল ধরবে।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, ছাত্রসমাজের মধ্যে ক্রমশ শৃঙ্খলার অভাব দেখা যাচ্ছে।

পথেঘাটে, অলিতে গলিতে ছাত্রসমাজ তাদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে শৃঙ্খলাহীনতার পরিচয় রাখছে। এভাবেই আগামী দিনের নাগরিকরা উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে।

নিয়ম শৃঙ্খলা পালন

ছাত্রসমাজকে মনে রাখতে হবে যে, এটাই হলো তাদের জীবন গঠনের সময়। এ হল নিঝরের স্বপ্নভঙ্গের কাল। জীবন এখন যে পথে পরিচালিত হবে সেটাই স্থায়ী পথ। শৃঙ্খলাবােধ হল জীবনের ভিত্তিশালা। যে ছাত্র শৃঙ্খলাকে শ্রী’ বলে মনে করবে, সে জীবনে সফল হবেই।

তাই নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা পরায়ণ হওয়া ছাত্রদের একান্ত কর্তব্য। প্রত্যেক কাজ যদি সুশৃঙ্খলভাবে যথানির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করা হয় তাহা হইলে সেই কাজে সফলতা লাভ হইবেই।

শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন, অচ্ছেদ্য।

সময়ের কাজ সময়েই করতে হবে। সময়ের অভাবে শেষ মুহূর্তের তাড়াহুড়ােয় অনেক কাজই নষ্ট হয়ে যায়। বিদ্যালয়ে পৌঁছােতে দেরি হয়, পরীক্ষায় উত্তর লিখতে দেরি হয়, ট্রেন ধরতে দেরি হয়।

জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা খেলার মাঠে যেমন প্রয়ােজন, বিদ্যালয়েও তেমনি প্রয়ােজন।

তাছাড়া জীবনে যদি ছাত্রগণ সময় সম্পর্কে অবহিত হয় তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে সময়ের অভাবে কোন কাজ সম্পন্ন হল না বলে ছাত্রদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে না।

মনে রাখিতে হইবে ‘সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। মৌমাছির জীবনের দিকে তাকাইলে ছাত্রগণ এই বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে পারবে।

শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা

আমরা জানি, কারণ ছাড়া কাজ হয় না। এবং এই কারণ অনুসন্ধানে জাতীয় জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

ধনী-দরিদ্র, শােষক-শােষিত প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রেণিসংঘাত সমাজে অশান্তির দুষ্ট ক্ষতের মতাে ছড়িয়েছে।

বেকার সমস্যা যুব সম্প্রদায়কে অন্ধকারের দিকে নিমজ্জিত করেছে। তাদের হতাশা, অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ দেশ তথা সমাজের প্রতি আনুগত্যহীন করেছে।

বাস্তবিকতাহীন শুষ্ক গ্রন্থনির্ভর শিক্ষা ছাত্রসমাজকে জীবনের নতুন পথ দেখাতে ব্যর্থ।

এছাড়া দারিদ্র্য, কুশিক্ষা প্রভৃতি সমস্যায়ও জাতীয় জীবন জর্জরিত। তাই আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবােধ ও নিয়মনিষ্ঠার অভাব। এ থেকে মুক্তি পেতে স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে অভ্যাস ও অনুশীলনের প্রয়ােজন।

শৃঙ্খলার অভ্যাস

ছাত্রের নিজের গৃহেই শৃঙ্খলাবােধ জন্মায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমােতে যাবার আগে পর্যন্ত সব কাজই সম্পন্ন করতে হবে শৃঙ্খলার সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করেই। এই বােধ শৈশবেই জাগ্রত হওয়া দরকার।

সুস্বাস্থ্য থাকা ও সুস্থ পরিবেশ

সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া ছাত্রদের আর একটি কর্তব্য। সুস্থ শরীরের অধিকারী না হলে কোন কাজেই উৎসাহ পাওয়া যায় না। সর্বদা রুগ্ন শরীরকে নিয়েই যদি ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে জীবনের আর সব কর্তব্য পালন হবে কি করে?

তাই প্রয়ােজন আগে স্বাস্থ্যকে গড়ে তোলা। নিয়মিত সময়ে শয্যাত্যাগ, স্নান, পরিমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং ব্যায়াম করিলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়। নিয়মিতভাবে খেলা-ধূলা, যৌগিক ব্যায়াম ইত্যাদি কিছুটা করে অভ্যাস করলে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়।

কিন্তু মনে রাখতে হবে যে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে গেলে যদি সর্বদা ব্যায়াম, খেলাধূলা ইত্যাদির দিকেই আসক্তি জন্মায় তাহলে সেটি ঠিক নয়। এইরকম করলে কর্তব্য পালনে ত্রুটি ঘটিবে। কোন জিনিষের বাড়াবাড়ি কোন সময়েই ভাল নয়।

কথায় আছে, নগরে আগুন লাগলে, দেবালয় কি রেহাই পায় সে আগুন থেকে? পায় না।

এই সূত্র ধরেই বলা যায়, সমাজ যদি খারাপ হয়ে যায়, দেশ যদি বিপন্ন হয়, কাল যদি বিরূপ হয়ে পড়ে, তখন চারদিকে প্রাচীর তুলে দিয়ে আমরা কি তার থেকে রেহাই পাব?

তাই ডাক্তার হয়ে রােগীকে ভালাে করে তােলা যেমন জরুরি কর্তব্য, তেমনি সমাজ ও দেশের সুস্থ পরিবেশ গড়ে তােলার দায়িত্ব আমাদের।

জ্ঞান অর্জন

পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারের আস্বাদও ছাত্রদের লাভ করতে হবে।

তাই বিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় পাঠ করার ফাকে ফাকে মহাপুরুষদের জীবনী, সগ্রন্থ, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদিও ছাত্রদের কিছু কিছু পাঠ করতে হবে।

ঐ সঙ্গে বিশ্বের হালচাল জানবার জন্য নিয়মিতভাবে সংবাদপত্রও পাঠ করা উচিত।

চরিত্র গঠন

ছাত্রজীবন প্রকৃতপক্ষে বীজ বােনার কাল। যথাসময়ে  যথাযােগ্যভাবে যদি বীজ বােনা হয় তাহলে সুফল লাভে নিশ্চিত হওয়া যায়।

সেইরূপ ছাত্র জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য গুলি যদি যথাযথভাবে পালিত হয় তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে সার্থকতা লাভ করা সহজ হয়।

এই সময়েই ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জীবনে লক্ষ্য স্থির করতে হয় এবং সেইভাবে চরিত্র গঠনও করতে হয়। এই সময়ে যদি ছাত্রদের যথানির্দিষ্ট নিয়মে গঠন না হয় তাহলে ভবিষ্যতে তাহাদের অশ্রুবিসর্জন করতে হবে।

ছাত্রদের হইতে হইবে ধীর, নম্র, বিনয়ী, সেবাপরায়ণ, নিঃস্বার্থপর এবং পরীশ্রমী।

ছাত্র জীবনে অসম্ভবও সম্ভব হয়। কারণ ছাত্রদের কোন পিছুটান নাই। তাদের হৃদয় এখন পবিত্র ও কোমল। তাই তাদের পক্ষে অসম্ভবকেও এই সম্ভব করে তােলাও সম্ভব হয়।

সমাজসেবা দরকার

সমাজসেবা বলতে আমরা কী বলতে চাই, সেটা এখন বুঝে নেওয়া দরকার। বর্তমানে নিরক্ষরতা হল আমাদের একটি সামাজিক ব্যাধি।

সুতরাং এই কাজে সকলের সঙ্গে ছাত্রদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধিতে অনেকদিন ধরেই আমরা আক্রান্ত, এই ব্যাধিকে তাড়াতে হবে।

একে তাড়াতে হলে ছাত্রদের সহযােগিতা বড়াে জরুরি। মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলে এ ব্যাধির প্রতিকার করতে হবে।

উপসংহার

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলারক্ষার গুরুত্ব-যে অপরিসীম, সেটি কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। কারণ, ছাত্রগণই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক।

তাহারা সুশৃঙ্খল হতে শিখলে, পরবর্তীকালে যখন তারা দেশকে নিয়ন্ত্রিত করিবে, তখন তার প্রভাব তাদের কার্যক্রমের উপর পড়ে দেশের কল্যাণ-সাধন করবে।

কিন্তু এই শিক্ষার দায়িত্ব কেবল ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদেরই নয়, তার দায়িত্ব যৌথভাবে অভিভাবকদের এবং শিক্ষাব্যবস্থার। মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ছাত্রজীবন।

এমন আনন্দময় জীবন আর নাই। আজ যে ছাত্র ভবিষ্যতে সে পরিপূর্ণ মানুষ।

ছাত্রজীবনকে পিছনে ফেলিয়া আমরা যখন জীবনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করি তখন নিত্যই আমাদের মনে ফেলে আসা ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে আর দুঃখে আমাদের হৃদয় ভরে যায়।