ভূমিকা
সত্যিই আমাদের যাত্রীবাহী বাসখানা নিয়ে বলতে পারতাম, আরােহীরা যদি জীবন্ত প্রাণী না হয়ে সােনার ধানের মতাে জড় বস্তু হত এবং বাসটি তাতে ভরে যেত।
মানুষ জড় পদার্থ হলে, মালের মতাে তাদের ঠাসাঠাসি পরিবহন করলে কিছুই ক্ষতি হত না।
কিন্তু আমরা যারা বাসের মধ্যে ঠাসা হয়ে আছি, তিলমাত্র পা রাখার স্থান নেই এবং শরীর নামক বস্তুকে সহযাত্রীদের দয়া ও করুণার ওপর ছেড়ে দিতে হয়েছে- তাদের অবস্থা দেখলে বাস্তবিকই দুঃখ হয়।
পটভূমি
দিনটি হল জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা দুপুর। জ্যৈষ্ঠের গুমােট আবহাওয়ায় সারা শরীর থেকে প্যাচপ্যাচে ঘাম ঝরছে, বাসভর্তি মানুষের নিঃশ্বাসে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
বাস চলতে থাকলে যেমন স্বস্তি পাওয়া যায়, তেমনি যাত্রী নামা-ওঠার জন্যে দাঁড়ালেই পরিত্রাহি অবস্থা।
আবার একটি সদ্যোজাত শিশু বাসের বদ্ধ গরমে কাদছে, আবার কোনাে বয়ােবৃদ্ধ যাত্রী পাশের যাত্রীকে রসিকতার সুরে বলছে- আপনি কি হাতটা আমার ঘাড়ের ওপর না রেখে থাকতে পারেন না?
কাছ থেকে কে যেন তার জবাবে বলে, দাদু, ওকে ক্ষেমা করে দেন; ও আসার সময় হাতখানা বাড়িতে রেখে আসতে ভুলে গেছে।
এত অস্বস্তিকর কষ্টের মধ্যেও হাসিঠাট্টার শব্দ সমগ্র বাসটিতে একটুখানি আনন্দের বার্তা এনে দেয়।
যাওয়ার পথে
যাত্রীবাহী বাসটি কোন অন্ধকার গুহাপথ পাড়ি দিয়ে আঁকুনি খেতে খেতে গড়িয়ে চলেছে। জানালার মধ্য দিয়ে বাইরের দুনিয়াকে দেখার সময় নেই। তবুও তার মধ্যে পারস্পরিক পেষণে নিজেদের প্রাণের অস্তিত্বটুকু অনুভব করি।
কণ্ডাক্টর আর তার সহযােগীদের হাঁক ডাকে স্টপেজের নাম উচ্চারণে মনে হয় বাসটি যেন তার নির্দিষ্ট পরিচিত পথে ছুটে চলেছে।
বাসের চলমান অবস্থায় যেমন কিছুটা স্বস্তি থাকে, তেমনই স্টপেজে এসে দাঁড়ালে বা ট্রাফিক জ্যামে পড়লে দলিত পিষ্ট হূদয় বুঝি সারা জীবনের ম্যাসেজের কাজটা সেরে ফেলেছে।
মনে হয় যেন নরক যন্ত্রণার হাত থেকে আজকের মতাে রেহাই পাওয়া গিয়েছে।
বাস্তব পরিস্থিতি
ভীড়ের বাসে একটুখানি জায়গা নিয়েও চেঁচামেচি পড়ে। হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম প্রায়। বিবদমান দু’পক্ষকে পাশাপাশি চলে শান্ত করার প্রয়াস। কেউ বলে, রাগারাগি করলে কি হবে? দু’দণ্ড পরে আমরা সবাই যে যার গন্তব্যস্থলে চলে যাব।
আর হয়তাে কখনাে দেখা হবে কি না সন্দেহ।
তবুও তিক্ততার পাশাপাশি এই গ্লানিটুকু থাকবে কেন? আবার ভিড়ে ঠাসা বাসের মধ্যেও এক যুবক সিট ছেড়ে দিয়ে পাশাপাশি এক বৃদ্ধকে বসার জায়গাও করে দেয়-যা সুস্থ মানসিকতারই দৃষ্টান্ত।
অভিজ্ঞতা
ভীড়ের বাসে আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি। মনে রাখতে হবে, ভীড়ের কষ্ট আমাদের অন্তরে থাকলেও আমরা সবাই সহযাত্রী।
মনুষ্যত্ব ও মানবিকতাবােধের জন্যই আমরা সুবিধা-অসুবিধায় পরস্পরের পাশে দাঁড়াই। কারণ আমরা মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং অন্যান্য প্রাণীদের থেকে স্বতন্ত্র। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
যেমন, সিটে বসা কোনাে যাত্রীকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী যদি তার এ্যাটাচি বা ব্যাগ ধরতে বলে, তখন তার এ্যাটাচি বা ব্যাগকে ধরার মধ্য দিয়ে যাত্রীটি মানবিকতার পরিচয় দেয়।
উপলব্ধি
চলমান বাসের শব্দ ও যাত্রীসাধারণের কোলাহলের মধ্যেও কণ্ডাক্টর হেল্পারদের ডাক দেওয়ার দিকে কান দিতে হয়েছে।
কেননা আমরা আমাদের নিজস্ব স্টপেজ যেন না ছেড়ে চলে যাই বা আমাদের নামার জায়গাটা যেন পার হয়ে না যায়।
তার জন্য এক স্টপেজ আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। গন্তব্যস্থলের নিশানা শুনেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর ঠেলে সােচ্চার কণ্ঠে চিৎকার করি- দাদা দয়া করে সাইড দেন, সাইড দেন দাদা প্লিজ।
স্টপেজ চলে গেলে তাে সর্বনাশ হবে। কেউই কারও কথায় কর্ণপাত করে না। কিন্তু নামতেই তাে হবে। অনেক ঠেলাঠেলি, ধবস্তাধ্বস্তির পর একটুকু ফাঁক-ফোকর করে তার ভেতর দিয়ে গলে পড়ি- হয়তাে বা মানব-প্রাচীর বলেই সম্ভব হয়েছে।
উপসংহার
বাস থেকে অবতরণ করার পর যেন মনে হয় পুনর্জন্ম হল। যেন কলুর ঘানি গাছে পিষ্ট করে ছিবড়া খইলের মতাে ফেলে রেখে যন্ত্রচালিত যানটি সিটি দিয়ে চলে যাচ্ছে।
এরকম অবস্থার কোনােদিন উন্নতি হবে কি না আমাদের জানা নেই।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমাদের হরেক রকম কাজের প্রয়ােজনে নিত্য-নৈমিত্তিক এভাবেই দলিত-পিষ্ট হয়ে যাতায়াত করতে হয়।
আর পীড়ন পেষণে অতিষ্ঠ হয়ে শরীর নামক বস্তুটিকে তুলে দিতে হয় সহযাত্রীদের দয়ার ওপর, তাদের দুরবস্থার শেষ নেই।
এভাবে কতদিন একটি জাতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে পারে? পরিবহন নিয়ে কত জল্পনা- কল্পনা-ই তাে প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকায় পড়ি, তা শুধু কথার কথা, কাজের কথা নয়।
আর এভাবে চলতে থাকলে জাতি কতদিন সুস্থভাবে চলবে তা নিয়েও নানা সমস্যাই সৃষ্টি হয়েছে।
এবং এজন্যই প্রয়ােজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা- যা বাস্তব রূপায়ণের সত্যিই এক কর্মকাণ্ড।