সূচনা
মা বাবার কাছে বন্যার গল্প শুনেছিলাম ; এই গল্প শুনে মনে মনে সাধ জগত বন্যা দেখার-কিন্তু বাবার মুখে যখন জানলাম যে আর বন্যা আসার কোন সম্ভাবনা নাই-তখন হতাশ হতাম।
কিন্তু আমার মনের সাধ যে হঠাৎ এভাবে পূর্ণ হবে তা কল্পনাই করতে পারিনি। ছােট বেলা থেকে মাষ্টার মশায়দের কাছে শুনে আছি যে পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল ; উপর আবার আকাশে যে জল আছে তার সবটা যদি একদিন পৃথিবীতে ঝরে পড়ে, তাহলে নাকি সমস্ত পৃথিবীটাই বন্যায় ভেসে যাবে।
কিন্তু একথা মাষ্টার মশায়দের মুখেই শুনেছি; সত্যি কথা বলতে কি এর সত্যতা সম্বন্ধে মনে মনে সন্দেহ ছিল।
সেদিনের অভিজ্ঞতা
মা বাবার কাছে বন্যার গল্প শুনেছিলাম ; এই গল্প শুনে মনে মনে সাধ জগত বন্যা দেখার-কিন্তু বাবার মুখে যখন জানলাম যে আর বন্যা আসার কোন সম্ভাবনা নাই-তখন হতাশ হতাম। কিন্তু আমার মনের সাধ যে হঠাৎ এভাবে পূর্ণ হবে তা কল্পনাই করতে পারিনি। ছােট বেলা থেকে মাষ্টার মশায়দের কাছে শুনে আছি যে পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল; উপর আবার আকাশে যে জল আছে তার সবটা যদি একদিন পৃথিবীতে ঝরে পড়ে, তাহলে নাকি সমস্ত পৃথিবীটাই বন্যায় ভেসে যাবে।
কিন্তু একথা মাষ্টার মশায়দের মুখেই শুনেছি; সত্যি কথা বলতে কি এর সত্যতা সম্বন্ধে মনে মনে সন্দেহ ছিল। এক কথা, বান আছে। সবারই চোখে মুখে দুশ্চিন্তা। আমার যদিও কোন অভিজ্ঞতা এ সম্পর্কে নাই, তবুও বড়দের মুখের সেই ছায়া আমাদের মনেও বুঝি পড়েছিল। কেউ বলছে, ভগবানপুরের ‘হােয়াংহাে’ কেলেঘাইর বাঁধ ভেঙ্গে বন্যা আছে।
কেউ-বা বলছে-‘বারচৌকার’ জল আসছে। বিকেলের দিকে দেখলুম দলে দলে লােক আমাদের গ্রামের পাশের খাল বাঁধের দিকে ছুটে চলেছে। সবারই হাতে কোদাল ও ঝুড়ি ; কারুর হাতে বাঁশ, কাটাগাছ, বস্তা, হ্যাজাক আরও কত কি! চারদিকে চিৎকার-বান এসেছে, সবাই বাঁধে এসো।
দাদা, বাবা সবাই বাড়ী থেকে চলে গেছেন। আমরা ক’ ভাই বােন, মা জ্যাঠাইমারাই শুধু বাড়ীতে থাকলাম। রাত্রে হৈ হৈ রব। সারারাত কারুর ঘুম নেই। বাঁধে আলো নিয়ে ছুটাছুটি।
বিকেলের দিকে ছাদে দাড়িয়ে দেখলাম আমাদের পাশের গ্রামের ধান ক্ষেতগুলিতে ধানের চারাগুলি তার দেখা যাচ্ছে না। সামনে যেন এক বিরাট নদী-চারিদিকে শুধু জল আর জল। দূরের ঘরবাড়ী দেখা যাচ্ছে না। রাত্রে বাবা অথবা দাদারা কেউ বাড়ী ফিরে আসেননি। সকালে শুনলাম যে আমাদের গ্রামে জল ঢুকেনি–বহু কষ্টে রেহাই পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাদের পাশের গায়ে জল ঢুকেছে। সকালে উঠেই ছুটলাম বন্যা দেখার জন্যে।
দেখলাম খালের ওপাশে বাঁধের উচু জায়গাতে এক বিচিত্র দৃশ্য। সেখানে এক সঙ্গে দাড়িয়ে আছে। মানুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগী। সঙ্গে শিয়াল, কুকুর, সাপ ইত্যাদি। সকলেই যেন শত্রুতা ভুলেছে। বিপদ যেন সবার। বাঁধের উপর ত্রিপল খাটিয়ে তারা বাসা বেঁধেছে। তাদের গ্রামের শতকরা প্রায় নব্বইটি বাড়ী হয় পড়ে গেছে, না হয় পড়ে যাবার অপেক্ষায় আছে। একদিকে দেখছি অসহায় ঘর ছাড়া মানুষের করুণ অবস্থা অন্যদিকে দেখছি বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে শত্ৰুমিত্র সবারই মিলিত প্রচেষ্টা।
লক্ষ্য করলাম জীবনে যাদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ ছিল তারা পরস্পর বন্ধুর মত বাঁধের উপর কাজ করে চলেছে। শুনলাম “ভগবানপুর থানার দুঃখ’ কেলেঘাই এবার আসেনি। কেলেঘাই সেই দোতালার মত উচু বাঁধও ভেঙ্গেছে-কিন্তু তা আমাদের থানার দিকে ভাঙ্গেনি।
ভেঙ্গেছে সবং ও পিংলার দিকে। খবর কাগজে এবং লােকের মুখে শুনলাম সবং ও পিংলার অধিকাংশ ঘরই গেছে পড়ে, বেশির ভাগ মানুষই হয়েছে গৃহহীন। আমাদের এদিকে এসেছে বার চৌকার জল। কাঁথি মহকুমার প্রায় সবটাই জলের নীচে। আমাদের মত কয়েকটি গ্রাম মাত্র কোন রকমে উদ্ধার পেয়েছে।
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি
২-৩ দিন পরে লক্ষ্য করলাম খালের স্রোতে ভেসে আছে কত গরু, কত ছাগল, কত ভেড়া। সঙ্গে কত ছােট ছােট ছেলে মেয়েও ভেসে চলেছে। তাদের পেছনে ভেসে চলেছে সম্ভবত তাদের মা বাবারা। আমাদের পাশের গ্রামের মানুষের অবস্থা যে ঠিক কি হয়েছে, তা প্রথম দিকে আমরা বুঝতে পারিনি।
কারণ দীর্ঘদিন বন্যা না আসার ফলে নৌকাও বেশি দেশে নাই। নৌকা সংগ্রহ করে যখন সরকারী কর্মচারীরা, সেচ্ছাসেবকগণ, গ্রামের বিশিষ্ট মানুষেরা ঐ গ্রাম দেখে ফিরে এলেন তখন তাদের মুখে যে সমস্ত কাহিনী শুনলাম তা প্রায় অবিশ্বাস্য।
সাহায্যের হাত
সঙ্গে সঙ্গে অসহায় বন্যাপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য সরকারী কর্মচারীরা নানা প্রকার খাদ্য নিয়ে এলেন। গ্রামে গ্রামে নঙ্গরখানা খােলা হােল। রিলিফ দেওয়া শুরু হােল। স্কুল কলেজের ছাত্রের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে এলেন রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম স্য, আনন্দমার্গ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান- তারাও অকৃপণহস্তে সাহায্য করে চললেন। পশ্চিম বাংলার খাদ্য মন্ত্রী, ত্রাণমন্ত্রী ও শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রীও বন্যা-পীড়িত অঞ্চল পরিভ্রমণ করে গেলেন।
তারা মানুষের কাছে দাড়িয়ে দিলেন ‘আশ্বাস, দিলেন ভরসা। ধানের বদলে যাতে এসব অঞ্চলে অন্য শস্য উৎপাদন করা যায়, সে ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিলেন। ক্রমে বন্যার জল নেমে যেতে লাগল। আমরা যারা বন্যা- পীড়িত নয়, অথচ বন্যার ভয়ে ভীত ছিলাম তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু পাশের গায়ে লাগল মড়ক।
গ্রামের হাসপাতাল থেকে ওষুধপত্র প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করা হােল। সরকারী ব্যবস্থাপনায়ও চিকিৎসার নানা ব্যবস্থা করা হােল। ১৫-২০ দিন পরে জলের মাত্রা কমল।
উপসংহার
জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা হল, কিন্তু মনে মনে ভাবছি এ অভিজ্ঞতা না হলেই বােধ হয় ভাল ছিল। মানুষের এত দুঃখ এত কষ্ট, প্রকৃতির হাতে মানুষের এই অসহায়তা দেখে মন বেদনায় ভরে গেল। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, শত্রুরও যেন এরূপ বিপদ কোনদিন না হয়।