ভুমিকা
অবকাশ বা অবসান আছে বলেই কাজের এত গুরুত্ব। কর্ম ও বিরাম, কাজ ও অবকাশ- এগুলি পরস্পর অঙ্গাঙ্গী সূত্রে আবদ্ধ।
কেননা কাজের মধ্যে অবকাশ আছে বলেই কাজের সাফল্য। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে অবকাশের মধ্যেই খুঁজে পায় কাজের আনন্দ।
অবকাশ কি
অবকাশ-এর আক্ষরিক অর্থ হল বিরাম, বিশ্রাম, থামা ইত্যাদি। মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অবকাশ।
মানুষ পথ চলে, সেই পথ চলার জন্যই তাকে থামতে হয়। এই যে চলার জন্য থামা বা সাময়িক বিশ্রাম- তা-ই হল অবকাশ। যাকে আমরা ছুটি বলে থাকি, সেই ছুটি হল অবকাশ।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ছুটি’ গল্পে ফটিকের ছুটি নয়, কারণ তা চিরকালের ছুটি। এই অবকাশ হল সাময়িক ছুটি, গানের সম-এর মতাে।
অবকাশের গুরুত্ব
নিত্য-নৈমিত্তিক একঘেয়ে জীবনের মাঝে অবকাশ হল আনন্দের, বিনােদনের এবং কর্মব্যস্ততা অপনােদনের মাধ্যম। আসলে অবকাশ মানেই নির্দিষ্ট নিয়মবন্ধনের বাইরে নিজের মতাে করে স্বাধীন বিচরণের এক অফুরন্ত অবসর।
কাজের সময় যে বাধ্যবাধকতা থাকে অবকাশের সময় সে বাধ্যবাধকতা তো থাকেই না, বরং এ সময়ে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। তাই অবকাশের গুরুত্ব এতাে।
দ্বিতীয়ত, অবকাশ না থাকলে কাজ করাটা মানুষের কাছে অনেকটাই কৃত্রিম হয়ে যেতাে।
তৃতীয়ত, অবকাশ থাকে বলেই কাজের মধ্যে উৎসাহ আসে, দুরূহ কাজও সহজ হয়ে যায়- ভাবী অবকাশের সৌজন্যে।
চতুর্থত, একটি কল চালাতে চালাতে যেমন তাকে বন্ধ করতে হয়, কলকে ভালাে করে চালানাের লক্ষ্যে, তেমনি মানুষের জীবনে কাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে অবকাশের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
যেমন, বিশ্বকর্মা পূজা আসলে কল-কে অবসর দেওয়া, উপবাসও তাই।
পঞ্চমত, অবকাশহীন জীবন ক্লান্তিময় ও অন্ধকারময়, তা নৈরাশ্য আনে। সুতরাং মানুষের জীবনে নৈরাশ্য ও হতাশা কাটাতে অবকাশের বিকল্প নেই।
তবে প্রচুর অবকাশ আবার নৈরাশ্য আনে। যেমন, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবনে প্রচুর অবকাশ তাদের নিঃসঙ্গতাকে আরাে বেশি করে ভাবিয়ে তােলে।
অর্থাৎ পরিমিত অবকাশ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে জড়িত।
ছাত্রছাত্রীদের অবকাশ
ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অবকাশ অত্যন্ত আনন্দের। পড়াশােনার চাপে এবং নিত্য-নৈমিত্তিক টাস্ক-এর ভারে যখন ছাত্রছাত্রীরা অবসন্ন ও ক্লান্ত হয়ে ওঠে, তখন অবকাশ তাদের দেয় মুক্তির আনন্দ।
বিদ্যালয়ে টিফিন কিম্বা ছুটির ঘণ্টা বাজলে তাদের উন্মাদনা দেখলে বােঝা যায়- অবকাশ ছাত্রছাত্রীদের কত আনন্দ দেয়।
স্কুল ছুটি মানেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেখা যায় বিনােদনের নানা উপকরণকে গ্রহণ করতে।
যেমন, ছােটোদের বাবা-মা বা অভিভাবকদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া এবং একটু বড়ােদের একটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল।
আবার বিভিন্ন রকমের খেলাধূলা করে, বিভিন্ন শখ মিটিয়ে, গান-বাজনা করে বা শুনে, কিম্বা নিছক আড্ডা মেরে বা পিকনিক করে, ঘুরে বেড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা ছুটির দিনগুলিকে কাজে লাগায়।
ছুটি থাকলে তাই ছাত্রছাত্রীদের এত মজা হয় যে ছুটির পর তাদের পড়াশােনায় মন বসাতে দেরী হয়।
অবকাশ যাপনের মাধ্যম
বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতিতে অবকাশ যাপনের মাধ্যমের কোনাে অভাব নেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ-এর মতাে বিনােদনের উপায়গুলি যেন নিমেষে হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে।
প্রথমত, অবসর যাপনের প্রথম উপায় হল আড্ডা দেওয়া বা আড্ডায় সঙ্গী হওয়া কফি হাউসের আড্ডায় বহু শিল্পী-সাহিত্যিকরা একসঙ্গে হতেন ও নিজেদের ভাববিনিময় করতেন।
দ্বিতীয়ত, খেলাধুলা অবসর যাপনের আর এক উপায়। যে কোনাে খেলাধুলা শরীর ও মনকে সতেজ করে।
তৃতীয়ত, বাইরে কোথাও বেড়ানাে বা বনভােজনের আনন্দে মিশিয়ে দেওয়া অবকাশ যাপনের আর এক মাধ্যম।
বেড়াতে গেলে মনের ক্লান্তি দূর হয়, অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা হয়, জীবনের বৈচিত্র্যও বাড়ে। সেই সঙ্গে বনভােজনও একঘেয়েমির তিক্ততা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়।
চতুর্থত, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব শখ থাকে। যেমন বাগান করা, ছিপ ফেলা, ছবি আঁকা, ঘরদোর পরিষ্কার করা, রান্নাবান্না করা ইত্যাদি। অবকাশ যাপনের ক্ষেত্রে এগুলি এক-একটি মাধ্যম।
যার দ্বারা নিজেদের কল্পনাশক্তির বিকাশ হয়, নিজেদেরকে সৃষ্টিকর্মে নিয়ােজিত রাখা যায়।
পঞ্চমত, টিভি দেখা, রেডিও শোনা, গান শােনা অবকাশ যাপনের অন্যতম মাধ্যম। বিনােদন অবকাশকেই আনন্দে ভরিয়ে দেয়। তাই গানের সুর, নাটকের অভিনয় মানুষকে এক অতিরিক্ত আনন্দে ও মাতিয়ে তােলে।
ষষ্ঠত, বইপড়া ও কিছু লেখালেখি করাকে অনেকেই অবকাশ যাপনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। বইপড়ার আনন্দ ও তার শিক্ষা এবং কিছু লিখে সৃষ্টিধর্মিতার সহে যুক্ত করা এর দ্বারা সম্ভব হয়।
সপ্তমত, ভালাে মানুষের সঙ্গ করা, ভালাে কথা শোনা, ভালাে সৌজন্য ও শিষ্টাচার আয়ত্ত করাও অবকাশ যাপনের উপায় হতে পারে।
অষ্টমত, অনেকেই আবার শুধু ঘুমিয়ে কিম্বা পরনিন্দা-পরচর্চা করে, খবরের কাগজ পড়ে, চায়ের কাপে তুফান তুলে, রাজনীতির কচকচিতে যােগ দিয়ে সময়টাকে অনর্থ করে তুলতে পারে এবং এভাবে অবকাশ যাপন করে।
আবার কোনাে বৈষয়িক লােক অর্থের হিসেবে কিম্বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে মনসংযােগ করে অবকাশ যাপন করে।
উপসংহার
সব জিনিসের যেমন ভালাে-মন্দ আছে, অবকাশেরও তা আছে। সেজন্য চাই পরিমিতিবােধ। অবকাশ কতটা প্রয়ােজন, কীভাবে সেই অবকাশ যাপন করব- এজন্য চাই যথার্থ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তার মূল্যায়ন।
তা না হলে যে আকাশ আনন্দের, যে অবকাশ নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনের প্রেরণার, তা শেষ পর্যন্ত অনর্থও ঘটাতে পারে।
যেমন, সামান্য আগুনে প্রদীপ জ্বালানাে যায়, আবার সেই সামান্য আগুনে মানুষের বাড়ি ধূলিসাৎও হয়ে যেতে পারে।